পিকাসো বৃদ্ধবয়সে এক তরুণীকে বিয়ে করেন। কয়েক বছর পর তরুণী তাকে ত্যাগ করে তালাক দেন (কিংবা হয়তো পিকাসোই এমন পরিস্থিতি নির্মাণ করেন যে তালাক ভিন্ন অন্য গতি ছিল না—কারণ তিনি গ্রেট আর্টিস্ট হন আর নাই হন, এ-তত্ত্বটি কিন্তু অনস্বীকার্য, গ্রেট আর্টিস্টদের যে-খামখেয়ালির বাতিক থাকে, মাথায় যে-ছিট থাকে সেটা তিনি পেয়েছেন ন-সিকে।) এবং পিকাসোর সঙ্গে তার দাম্পত্যজীবন সম্বন্ধে একখানি পুস্তক প্রচার করেন। পিকাসো নাকি সেটা ঠেকাবার চেষ্টা করে বিফল হন। সেই জীবনীটি যখন ধারাবাহিকভাবে কন্টিনেন্টের একটি সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হয় তখন তার প্রায় সবকটা কিস্তিই আমি পড়ি, এবং আমার মনে সবচেয়ে বেশি বিস্ময় সৃষ্টি করল– আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলুম বললেও অত্যুক্তি হয় না যে, সে পুস্তিকায় পিকাসো তার তরুণী স্ত্রীকে আর্ট বলতে কী বোঝায় এবং এই বিষয় নিয়ে যেসব আলোচনা তার সঙ্গে করেন সেগুলো সব প্রাচীন যুগের কথা; অর্থাৎ সেই মাইকেল এঞ্জেলোর আমল থেকে প্রায় একশো বসর পূর্বপর্যন্ত আলঙ্কারিক, কলারসিকরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আর্টের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, আর্ট-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে যেসব অভিমত প্রকাশ করেছেন, পিকাসো মোটামুটি তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র!
আমি তখন চিন্তা করে বিহ্বল হয়েছি, এই যদি আর্ট সম্বন্ধে পিকাসোর ধারণা হয় তবে তাঁর আঁকা ছবির সঙ্গে এ ধারণার কোনও সামঞ্জস্যই তো খুঁজে পাচ্ছিনে! একদিকে লোকটি আর্ট সম্বন্ধে ক্ল্যাসিকাল, অ্যাকাডেমিক ধারণা পোষণ করেন, আর অন্যদিকে তিনি একে যাচ্ছেন তার ভাষাতেই বলি– বিজার গ্রোটেক যতসব মাল!
এ যেন, আপনি নামতা শিখেছেন ঠিকই, কিন্তু অঙ্ক কষার বেলা করছেন ৩x৪ = ৮২, ৭+৫ = ২!
পিকাসোর এই বিবৃতিটি পড়ে আমার মনের ধন্দ গেল। তার আদর্শ ছিলেন জিতো, রেমব্রান্টই, কিন্তু তিনি জানতেন প্রথমত, ওদের স্তরে আদৌ পৌঁছতে পারবেন কি না; দ্বিতীয়ত, পৌঁছতে পারলেও বাজারে সেই প্রাচীন ঢঙের ছবির চাহিদা আজ আর আদপেই নেই; তৃতীয়ত, তারও খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন এবং সর্বশেষে, সেই অর্থের জন্য যখন ছবি আঁকব আপন আদর্শ বেহায়া বিসর্জন দিয়ে– তবে সেইটাই কবি পূর্ণমাত্রায় ইংরেজিতে যাকে বলে উইথ এ ভেনজেনস, উর্দুতে বলে, পড়ে তলওয়ার দামকে সম্ভালে কোই– তলওয়ার যখন ধরেইছি তখন রক্তের ছিটে পড়বে বলে কুর্তার দমন (প্রান্ত, অঞ্চল) অন্য হাত দিয়ে সামলানোটা বিলকুল বেকার।
অবশ্য এসব তর্কবিতর্কের অর্থ হয়, যদি আমরা নিঃসন্দেহে ধরে নিই যে পিকাসো এ-বিবৃতিতে প্রাণের কথা খোলাখুলিই বলেছেন, সজ্ঞানে সত্যভাষণই করেছেন। নইলে কাল যদি আরও পয়সা কামানোর জন্য, বা বিনা-কারণেই আরেকটা নয়া ফয়তা ঝেড়ে বলেন, না না, ওটা আমার সত্য বিবৃতি নয়। আমি শুধু রগড় দেখবার জন্য এই মস্করাটা করেছিলাম আমার অন্ধ স্তাবক, এবং ওইসব মূর্ষ ধনীরা যারা নৃত্য করতে করতে আমার ছবি কিনেছে হুজুগে মেতে, ন্যায্যমূল্যের শতগুণ বেশি টাকা ঢেলে, তারা তখন কী বলে?–সোজা ইংরেজিতে আই উয়োজ পুলিং দেয়ার লেগ!– তখন আজ যেসব প্রাচীনপন্থীরা এই হাটের মধ্যিখানে হাঁড়ি ভাঙাটা দেখে উল্লাসে চিৎকার করে উঠেছেন, তাঁরা লুকোবেন কোন ইঁদুরের গর্তে!
অবশ্য শেষপর্যন্ত কর্তাভজাদের কোনও দুশ্চিন্তা নেই। তারা বলবেন, আজ যদি শেক্সপিয়ারের স্বহস্তে লিখিত একখানা গোপন ডাইরি বেরোয় যাতে তিনি লিখেছেন, আমি হতে চেয়েছিলুম হোমার, ভার্জিলের মতো কবি, কিন্তু যখন দেখলুম এ যুগে সেসব কবিদের চাহিদা নেই তখন হয়ে গেলুম পাবলিক এন্টারটেনার- ভাঁড় তা হলেই কি আমরা সেটা মেনে নেব, আর বলব, শেক্সপিয়ার গ্রেট পোয়েট নন!,
মুসলমানদের ভিতর একাধিক সম্প্রদায়ের লোক বিশ্বাস করেন, তাঁদের সপ্তম ইমাম (পৃথিবীতে আল্লার প্রতিভূ) অদৃশ্য হয়ে যান, তিনি সত্যি সত্যি মারা যাননি– সময় হলেই তিনি অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে মাহূদি (কল্কি) রূপে আত্মপ্রকাশ করবেন। অন্য সম্প্রদায় বলেন, সপ্তম ইমাম না, অদৃশ্য হন দ্বাদশ ইমাম, তিনিই মাহদিরূপে ইত্যাদি। তৃতীয় সম্প্রদায় বলেন, দ্বাদশ না, চতুর্বিংশতি ইত্যাদি।
এদের সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে স্পেনের আন্দালুশ প্রদেশের মৌলানা ইবন হাজম যেন এদের বাবদে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে মাথা থাবড়াতে থাবড়াতে বলছেন, অলৌকিক এদের অন্ধবিশ্বাসের পঙ্ককুণ্ডে নিমজ্জিত হয়ে থাকবার ক্ষমতা! কারও ইমাম অদৃশ্য হয়েছেন অষ্টম শতাব্দীতে, কারও নবম, কারও-বা দশমে। যে জিনিস হারিয়ে গেছে (অদৃশ্য হয়েছে) দুশো তিনশো চারশো বছর আগে, এরা এখনও সেটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেউবা আবার বলে, অদৃশ্য ইমাম আছেন একটা মেঘের আড়ালে। আহা, যদি জানতুম কোন মেঘটা! চিৎকারে চিৎকারে তাকে অতিষ্ঠ করে বলতুম, সশরীরে নেমে এসে কুলে বখেড়ার ফৈসালা করে দাও না, বাবা! তাজ্জব তাজ্জব!
পিকাসসোর আগের বিবৃতি যদি সত্য হয় তবে আমাদের বলতে হবে, ভক্তজনের উপাস্য পিকাসো তিনি আত্মহত্যা করলেন। আর ভক্তজন বলবেন, তিনি মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হয়েছেন।
.
আর যেসব সরলজন বিশ্বাস করে ওইসব বিজারের বাজার বিলকুল ফুটা, মশকরা করে ছবির ধাঁধা বানিয়ে আর আরাবে একে প্রকৃত কলাসৃষ্টি হয় না, তার জন্য প্রচুর অক্লান্ত তপস্যার প্রয়োজন তাদের জন্য নিম্নের উদ্ধৃতিটি তুলে দিলুম; কিছুতেই লোভ সামলাতে পারলুম না আমার চোখে পড়েছে এই আজ : কিছুদিন আগে কোনও একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আলাউদ্দিন সাহেব এবং গোলাম আলি সাহেবকে সংবর্ধনা জানানো হয়। অভিনন্দনের উত্তরে আলাউদ্দিন সাহেব বললেন– নাই বছর ধরে সঙ্গীতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর দর্শনের আশায় সাধনা করে আসছি। একটিমাত্র আশায় দিনের পর দিন সাধনা করে আসছি। একদিন-না-একদিন তিনি প্রসন্ন হয়ে আমাকে অমরাবতীর সংগীত-মন্দিরে ঢোকবার অনুমতি দেবেন। আজও আমার সাধনার শেষ নেই। এতদিন সাধনার ফলে দূর থেকে শুধু মন্দিরের আবছায়া ছায়াটা যেন একটু একটু নজরে আসছে।