অন্যত্র সবিস্তর লিখেছি, হিটলারের মৃত্যুর পর লিঙে শহন্তে বন্দি হন এবং দীর্ঘ বসর রুশ-কারাগারের দুঃসহ ক্লেশ সহ্য করার পর জর্মনিতে ফিরে এসে হিটলার সম্বন্ধে একখানি চটিবই লেখেন। এফা সম্বন্ধে কৌতূহলী পাঠক এই পুস্তিকায়ই তার সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে বিশ্বাস্য খবর পাবেন। হিটলার সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন নিরপেক্ষ দৃষ্টিবিন্দু থেকে, কিন্তু এফা সম্বন্ধে লিখেছেন বড়ই দরদ-ব্র ভাষায়। তিনি ইচ্ছে করলেই হিটলার-এফার সম্পর্ক সম্বন্ধে রগরগে মার্কিনি ভাষায় কেলেঙ্কারি কেচ্ছা লিখতে পারতেন– কোনও সন্দেহ নেই তিনি রুশ দেশ থেকে পশ্চিম জর্মনিতে ফেরা মাত্রই মার্কিন রিপোর্টাররা তাকে চেপে ধরে, অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে হিটলার-এফার নব বিদ্যাসুন্দরের জন্য আপ্রাণ পাম্প করেছিল কিন্তু সেসময় বিশেষ কিছু তো বলেনইনি, পরেও পুস্তিকা রচনাকালে লিখেছেন যেটুকু নিতান্তই না লিখলে সত্য গোপন করে এফার প্রতি অবিচার করা হয়। এই অন্তর্নিহিত শালীনতাবোধ ছিল বলেই হিটলার ও এফা উভয়েই তাকে বন্ধুর চোখে দেখতেন। এটা এমন কিছু সৃষ্টিছাড়া আজগুবি ব্যাপার নয়। এ দেশের পাঠান দাসবংশের ইতিহাস যারা মন দিয়ে পড়েছেন, তারাই এর সত্যতার নজির সে ইতিহাসে পাবেন এবং লিঙে তো কিছু ক্রীতদাস নন!!
তাই এফাতে-লিঙেতে এমনিতেই চিঠিপত্র চলত। হিটলার সেটা জানতেন। তাই তিনি যে কাজকর্মে আকণ্ঠ নিমগ্ন, তিনি যে কোন করার জন্য মন্ত্রণাকক্ষ ত্যাগ করে পাঁচ মিনিটের তরেও আপন খাস কামরায় যেতে পারছেন না, এটা তার গাফিলতি নয়, বস্তুত তার এই অপারগতা সম্বন্ধে তিনি নিজেকে দোষী মনে করেন এসব কথা লিঙেকে গুছিয়ে লিখতে বলতেন।
হিটলার যে এফাকে কখনও বার্লিনে আসতে দিতেন না, তা নয়। অবশ্য অতিশয় কালেকশ্বিনে। জব্বর পার্টি-পরবের স্টেট ব্যাঙ্কুয়েট না থাকলে অন্তরঙ্গজন তথা এফার সঙ্গে তিনি ডিনার-লাঞ্চে বসতেন। এফাকে তার বাঁ দিকের চেয়ারে বসাতেন। এফা ঠিকমতো খাচ্ছেন কি না, তার পছন্দসই খানা তৈরি হয়েছে কি না তাই নিয়ে পুতুপুতু করতেন এবং সবাই বুঝতে পারত তিনি এষাকে সর্বাপেক্ষা বেশি সম্মান দেখাচ্ছেন। কিন্তু যেদিন স্টেট ব্যাঙ্কুয়েট বা বাইরের লোক খানা খেতে আসত, সেদিন এফাকে উপরের তলায় হিটলারের চারজন মহিলা সেক্রেটারি ও তার খাদ্যরন্ধনের অধিকত্রীর(৩)সঙ্গে খানা খেতে হত। অবশ্য এ ব্যবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হল, যখন হিটলারের দফতরের এক উক্ত অফিসার, ফেগেলাইন বিয়ে করলেন এফার এক বোনকে। তখন হিটলার-সমাজের একটুখানি বৃহত্তর চক্রে এফাকে পরিচয় দেওয়া হত, সম্মানিত অফিসার ফেগেলাইনের শ্যালিকারূপে? মায়ের ছেলে নয়, শাড়ির মেয়ের বর!
বিরাট বিরাট লক্ষজন পরিপূর্ণ সভাতে, যেখানে হিটলার ওজস্বিনী বস্ত্রভাষিণী খাপ্তারি লেকচার ঝাড়বেন, সেখানে তাকে বিশেষ আসন দেওয়া হত না। তার এবং হিটলারের আর পাঁচজন কর্মচারীর সঙ্গে তিনি সবার সঙ্গে মিশে গিয়ে দয়িতের জনগণমনচিত্তহারিণী বক্তৃতা শুনতেন।
হায়! একে কী বলব বড় দুঃখে সুখ বা বড় সুখে দুঃখ? আমি এবাবদে মূর্খ–আবার বিদ, সম্মানিত সখা ব্রিাম এরকম একটা মোকা পেলে ঝপ করে একটা অকল্পনীয় পান করে খ করে একটা আরও অচিন্তনীয় সুমধুর সুভাষিত ম্যাক্সিম বানিয়ে ফেলতেন পুরো দেড় গণ্ডা শব্দ ব্যবহার না করেই। এই একটা ব্যাপারে লোকটা মখি-চো কস। অভিধানের শব্দভাণ্ডার যেন ব্যাঙ্কের ভল্টে লুকানো চিত্রতারকাদের সকলের না কারও-কার ইনকাম-ট্যাক্স অফিসারকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শক সম্পদ।
আমি কিন্তু দেখছি, এর ট্রাজিক দিকটা। পিতামহ ভীষ্মের পরই যে বীরকে এ ভারত সর্বসম্মত স্বীকৃতি দিয়েছে তিনি একচক্রা ভদ্রোত্তম কমান্ডার-ইন-চিফ ফিল্ড মার্শাল কর্ণ। তিনি যখন কুরুপ্রাঙ্গণে শৌর্যবীর্য দেখাচ্ছেন, তখন মাতা কুন্তী তার প্রতি-সাফল্যে কি তার মাতৃগর্ব, মাতৃশ্লাঘা প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। শাস্ত্রোদ্ধৃতি দিতে পারব না, তবে বাল্যবয়সে আমার সংস্কৃত শিক্ষার প্রথম গুরু আমাকে সঙ্গোপনে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে বলেছিলেন, মাতা কুন্তীর সর্বাপেক্ষা প্রিয়সন্তান ছিলেন কর্ণ।
এফা ব্রাউনের ওই একই ট্র্যাজেডি। সর্বজনসমক্ষে তিনিও গাইতে পারেন না– বধু তুহরি গরবে গরবিণী হয়, রূপসী তুহরি রূপে।
অভিমানিনী পাঠিকা, তুমি হয়তো শুধোবে, এ হেন ভণ্ডামির অপমানজনক পরিস্থিতি একা মেনে নিলেন কেন? এর উত্তরে আমার নিজের কোনও মন্তব্য না দিয়ে শুধু নিবেদন :
চত্রাবলি কুঞ্জে গিয়ে
সারা নিশি কাটাইয়ে
প্রভাতে এসেছ, শ্যাম,
দিতে মনোবেদনা।
———-
১. বৈদিক যুগে আমাদের ভিতর সহমরণ প্রথা প্রচলিত ছিল কি না, তার সমাধান এখনও হয়নি। এস্থলে লক্ষণীয়, হিটলার নিজেকে আর্য বলে শ্লাঘা অনুভব করতেন। তাই হয়তো প্রথমে কিছুটা আপত্তি জানানোর পর এই সতীদাহে সম্মত হন। পাঠক এ নিয়ে চিন্তা করতে পারেন।
২. এফার সঙ্গে লিঙের আরেকটা মিল আছে। বার্লিন যখন প্রায় চতুর্দিক থেকে বেতি, শেষ পরাজয় সুনিশ্চিত, কিন্তু পালাবার পথ তখনও ছিল, সে সময় হিটলার লিঙেকে ডেকে বলেন, তুমি আপন বাড়ি চলে যাও। লিঙে অসম্মতি জানান এবং সংক্ষেপে যা বলেন তার মোদ্দা : যাকে আমি এত বৎসর ধরে সেবা করেছি তাকে তার শেষ মুহূর্তে আমি ত্যাগ করতে পারব না। এবং সবাই জানেন, এফাও হিটলারের কড়া আদেশ সত্ত্বেও তাকে ত্যাগ করেননি।