এবার হিটলার করলেন ভিন্ন ব্যবস্থা। ততদিনে তিনি রীতিমতো বিত্তশালী হয়ে গিয়েছেন। হিটলারের আপন কর্মস্থল মনিক শহরে তিনি এষার জন্য ছোট্ট একটি ভিলা, মোটর কিনে দিলেন এবং মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিলেন।
অর্থাৎ তিনি হিটলারের একমাত্র রক্ষিতা হিসেবে হিটলারমণ্ডলীতে আসন পেলেন। এস্থলে রক্ষিতা বলাটা হয়তো ঠিক হল না। কারণ ইয়োরোপের প্রায়ই অনেকে কয়েক বৎসর পরে এই রক্ষিতাকে বিয়ে করে তাকে সমাজে তুলে নেন। এবং সমাজপতিরাও বধূর অতীত সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন তোলেন না। আরেকটি দৃষ্টান্ত দিই : এদেশে যদি বিয়ের তিন-চার মাস পর কোনও রমণী বাচ্চা প্রসব করে, তবে হইচই পড়ে যায়। ইয়োরোপে আদৌ না। আমার যতদূর জানা গির্জা পর্যন্ত কোনও প্রশ্ন না তুলে বাচ্চাটাকে ব্যাপ্টিস্ট করে তাকে ধৰ্মত সমাজে তুলে নেয়।
অবশ্য হিটলার সমস্ত ব্যবস্থাটা করলেন অতিশয় গোপনে। পূর্বেই বলেছি, তার এবং এফার চাকর মেড় তথা অতিশয় অন্তরঙ্গজন হাড়ে-মাসে জানতেন তারা যদি এই প্রণয়লীলা নিয়ে সামান্যতম আলোচনা করেন–বাইরের লোককে খবরটা জানাবার তো কথাই ওঠে না তা হলে তিনি পার্টির জব্বর পাণ্ডাই হন আর জমাদারণীই হোক, তাঁরা যে তদ্দশ্বেই পদচ্যুত বহিস্কৃত হবেন তাই নয়, কপালে গুম-খুনও অনিবার্য। কারণ হিটলার বহু বিষয়ে নির্মম। এদেশের কর্ণধার হওয়ার পূর্বে এবং পরেও হিটলার- হিলার বিস্তর গুম-খুন করিয়েছেন।
ওদিকে এফার যে ধার্মিক চরিত্ৰশীল জনক-জননী হিটলারের সঙ্গে তাদের কুমারী কন্যার অন্তরঙ্গতার কঠোর কঠিনতম প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তারাও এ ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নিলেন। এটাকে প্রতিরোধ করলে একওয়ে মেয়ে যদি আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে, এবং যদি সফল হয়ে যায়!
আমার দুঃখ শুদ্ধ-পাঠটি আমাদের মনে নেই : মোটামুটি যে মেয়ে–
মরণেরে করিয়াছে জীবনের প্রিয়।
কারও কোনও উপদেশ কান দিবে কি ও?
এফার নিতান্ত ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গজন ছাড়া আর সবাই বিশ্বাস করত, এফা ফটোগ্রাফ দোকানে কাজ করেন। তিনি হমানের স্টুডিয়োতে প্রতিদিন হাজিরা দিতেন।
.
এর কিছুদিন পরে ১৯৩৩-এর ৩০ জানুয়ারি হিটলার হয়ে গেলেন জর্মনির কর্ণধার– প্রধানমন্ত্রী চ্যানসেলার। তাকে তখন স্থায়ীভাবে বাস করতে হল বার্লিনে–্যুনিক পরিত্যাগ করে। এখন তিনি এফাকে নিয়ে পড়লেন বিপদে। এতদিন শুধু কম্যুনিস্টরাই তাদের আধা-পাকা গোয়েন্দাগিরি করেছে হিটলারের। এবারে জুটলো তাবৎ মার্কিন খবরের কাগজের দুদে দুদে রিপোর্টার পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক শায়রারও তাদেরই একজন। এদের চোখ দু-নলা বন্দুকের মতো গভীর অন্ধকারেও এক্স-রে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে জানে শিকারের দিকে। এবং কারও যে কোনও ব্যক্তিগত জীবনের প্রাইভেসি থাকতে পারে সেটা তাদের শাস্ত্রে-আদৌ যদি তাদের কোনও শাস্ত্র থাকে লেখে না। পাঠক শুধু স্বরণে আনুন ইংল্যান্ডের রাজা যখন মিসেস সিমনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তখন সে কেচ্ছাকে তারা কী কেলেঙ্কারির রূপ দিয়ে দিনে দিনে রসিয়ে রসিয়ে মার্কিন কাগজে প্রকাশ করেছে। তার তুলনায় হিটলার কোন ছার! ব্যাটা আপস্টার্ট যুদ্ধের সময় ছিল নগণ্য করপোরেল– তার আবার প্রাইভেট লাইফ! সেটাকেও আবার রেহাই দিতে হবে! হোঃ!
কাজেই এফাকে বার্লিনে আনা অসম্ভব।
ফলস্বরূপ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫-এ হিটলারের আত্মহত্যা করা পর্যন্ত সুদীর্ঘ বারোটি বৎসর কবির ভাষায় নারীজীবনের শ্রেষ্ঠ দ্বাদশ বৎসর একা পেলেন আগের তুলনায় অল্পই, এবং ক্রমশ হ্রাসমান। তাই সহমরণের বহু আগে থেকেই একা একাধিক বন্ধুবান্ধবীকে বিষণ্ণকণ্ঠে বলেছেন, ১৯৩৩-এর জানুয়ারি (অর্থাৎ হিটলার যেদিন চ্যানসেলর হন) আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা নির্মম দিবস ট্র্যাজিক ডে, ট্রাগিশা টাখ।
যেদিন মিত্রপক্ষ ফ্রান্সে অবতরণ করে কালক্রমে জমনি জয় করে সেটাকে বলা হয় ডি-ডে (DDay)। সেটা ৬ জুন ১৯৪৪। ১৯৩৩-এর ৩০ জানুয়ারিতেই কিন্তু আরম্ভ হয় অভাগিনী এফার ডি-ডে। কিন্তু এসব কথা পরে হবে।
বার্লিনে কর্মব্যস্ত হিটলার অ্যানিকে আসার সুযোগ পেতেন কমই। কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা মনিকে ট্রাককল করে তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আলাপ করে নিতেন। এবং টেলিফোন লাইনটি এমনভাবে নির্মিত ছিল যে, এফা-হিটলার কনেকশান হয়ে যাওয়া মাত্রই দুই প্রান্তের টেলিফোন অপারেটররা কিছুই শুনতে পেত না।… এবং যে স্থলে ট্রাকলের অষ্টপ্রহরব্যাপী এহেন সুবিধা সেখানে চিঠিচাপাটির বিশেষ প্রশ্ন ওঠে না– ওদিকে আবার চিঠিপত্র লেখার ব্যাপারে হিটলার ছিলেন হাড় আলসে। (জর্মনে স্টিভঙ্কেতের শ্রাইবফাউল দুর্গন্ধময় লেখন-আলসে)। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন আক্ষরিক অর্থে হিটলারের দম ফেলার ফুরসত নেই, ক্রমাগত একটার পর আরেকটা মিলিটারি কনফারেন্স হচ্ছে–তখন তিনি তার অন্তরঙ্গতম ভ্যালে লিঙেকে বলতেন, হে লিঙে, তুমি ঝপ করে একাকে দুটি লাইন লিখে দাও না। তখন প্রায় ঘন্টায় ঘন্টায় হিটলারের কোনও-না-কোনও কর্মচারী প্লেনে করে মনিক যাচ্ছে। ঘন্টা তিনেকের ভিতর চিঠি এফার হস্তগত হত।
ভ্যালে বলতে ভৃত্যও বোঝায়। কাজেই পাঠক নিশ্চয়ই মর্মাহত হয়ে শুধাবেন, কী! চাকরদের দিয়ে প্রিয়ার উদ্দেশে চিঠি লেখানোর সৎ বেআদবি তো বটেই তার চেয়ে বটতলার সচিত্র প্রেমপত্র থেকে দু-পাতা কেটে নিয়ে খামে পাঠিয়ে দেওয়া ঢের ঢের বেশি শৃঙ্গাররসসম্মত! কিন্তু পাঠককে স্বরণ করিয়ে দিই- হিটলার, এফা ও ভ্যালে লিঙে তিনজনই ছিলেন নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক। এমনকি লিঙের সামাজিক (রাজনীতির কথা হচ্ছেনা) প্রতিষ্ঠা ছিল হিটলারের চেয়ে উচ্চতর পর্যায়ের। তদুপরি, হিটলারের হাজার হাজার খাস সেনানীর (এস-এ) মাঝখান থেকে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর লিঙেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল এবং সেনাবাহিনীতে তিনি ছিলেন প্রায় কর্নেলের কাছাকাছি। এবং সর্বশেষ বক্তব্য, হিটলার মনিকে এলেও তার অধিকাংশ সময় কাটত রাষ্ট্রকার্যে। সে সময় ঘন্টার পর ঘন্টা এফাতে-লিঙেতে সময় কাটাতেন গালগল্প করে। এফা জানতেন, পুরুষদের ভিতর লিঙেই দশ-বারো বছর ধরে হিটলারের সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং হিটলারও তার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতেন। একা মেয়েদের ভিতর সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তিনী। অতএব দুজনার ভিতর একটা অন্তরঙ্গতা জমে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। আমার মনে হয়, একা এই লিঙেকে তার হৃদয়বেদনা যতখানি খুলে বলেছেন, অন্য আর কাউকে অতখানি বলেননি।(২)