সব ঐতিহাসিক বলেছেন, এফা ছিলেন রাদার এমৃটি-হেডেড অর্থাৎ সরলা বুদ্ধিহীনা। কিন্তু তাতে কী এসে-যায়? অম্মদেশীয় এক বৃদ্ধ চাটুয্যে মহারাজকে জনৈক অর্বাচীন শুধিয়েছিল প্রেমের খবর তিনি রাখেন কি, তিনি বৃদ্ধ, তার কটা দাঁত এখনও বাকি আছে? গোস্সাভরে তিনি যা বলেন তার মোন্দা– ওরে মূর্খ, প্রেম কি চিবিয়ে খাবার জিনিস যে দাঁতের খবর নিচ্ছিস? প্রেম হয় হৃদয়ে। বিলকুল হক কথা। এবং সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলতে পারতেন, প্রেম নামক আদিরসটি মস্তিষ্ক থেকে সঞ্চারিত হয় না।
তাই এফা ওইসব চকলেটাদি সওগাত বান্ধবী, সহকর্মীদের ফলাও করে দেখাত, পিকনিকের বর্ণনা ফলাওতর করে সবিস্তর বাখানিত এবং ভাবখানা এমন করত যে, হিটলার তার প্রেমে রীতিমতো ডগোমগোজরোজরোমরোমরো।
এস্থলে ইয়োরোপীয় সরল কুমারীরা যা সর্বত্রই করে থাকে এবং অধুনা কলকাতা-ঢাকাতে তাই হচ্ছে) একা তাই করলেন। নির্জনে একে অন্যে যখন দুই দুহ, কুহু কুহু তখন আশকথা-পাশকথার মাঝখান দিয়ে যেমন টেবিলের ফুলদানির দেখা-না-দেখার ফুলের মাঝখান দিয়ে জনে একে বলে প্রু দ্য ফ্লাওয়ারস- বিবাহ নামক সেই প্রাচীন সনাতন প্রতিষ্ঠানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা দিলেন। নিশ্চয়ই একাধিকবার।
পূর্বেই বলেছি, হিটলার কিন্তু পৈতে চুয়ে কসম খেয়ে বসে আছেন, বিবাহবন্ধন নামক উদ্বন্ধনে তিনি কাট্যা ফালাইলেও দোদুল্যমান হতে নিতান্তই অনিচ্ছক। এবং ঝাৎ ডিপ্লোমেট এই অস্বস্তিকর বাক্যালাপ কী করে এড়াতে হয়, সেটা খুব ভালো করেই জানতেন।
এটা বুঝতে সরলা, নীতিশীল পরিবারে পালিতা এফার একটু সময় লেগেছিল। ইতোমধ্যে তার রক্ষণশীল পিতামাতা এফার সঙ্গে হিটলারের ঢলাঢলির খবর পেয়ে গিয়েছে। তারা মেয়েকে বুঝিয়ে দিলেন হয় হিটলার তোমাকে বিয়ে করুক, নয় তুমি তার সঙ্গ ত্যাগ কর।
পিতামাতার প্রতি বিঘ্ৰা এই কুমারী তখন কী করে?
হঠাৎ ওই সময়ে একদিন হফমান সখা হিটলারকে টেলিফোন করলেন যদুর সম্ভব তাড়াতাড়ি আমার বাড়ি চলে আসুন।
হিটলার : কেন, কী হয়েছে?
হফমান : আসুন না, সবকথা এখানে হবে। হফমান এবং হিটলার দুজনেই জানতেন তাদের টেলিফোনের কথাবার্তা পুলিশ ট্যাপ করে।
হিটলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই হমানের ফ্ল্যাটে পৌঁছলেন। শুধোলেন, কী হয়েছে ব্যাপার কী?
হফমান : বড় সিরিয়াস। এফা পিস্তল দিয়ে বুকে গুলি মেরে আত্মহত্যা করার চেষ্টা নেয়। তাকে অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়–
বিদুৎস্পৃষ্টের ন্যায় হিটলার বাধা দিয়ে বললেন, কিন্তু জানাজানি হয়নি তো- তা হলেই তো সর্বনাশ!
এস্থলে লক্ষণীয় যে, হিটলার দুঃসংবাদ পাওয়ামাত্রই সর্বপ্রথম নিজের স্বার্থের কথাই ভেবেছেন। তার পার্টি এবং বিশেষ করে গ্যোবেলস সাধারণ্যে তার যে ইমেজ গড়ে তুলছিলেন, সেটা জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারীর। এখন যদি তার দুশমন কম্যুনিস্টরা জেনে যায় যে, তিনি গোপনে একটা মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করতেন এবং সেই সরলা কুমারী যখন যুক্তিসঙ্গত নীতিসম্মত পদ্ধতিতে হিটলারকে সেই ভাব-ভালোবাসার অন্তে যে প্রতিষ্ঠান থাকে, অর্থাৎ বিবাহ, সেটা প্রস্তাব করে তখন তিনি ধড়িবাজ, কাপুরুষ, বেইমানের মতো মেয়েটাকে ধাপ্পা মারেন, এবং ফলে ভগ্নহৃদয় কুমারী আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তবেই তো চিত্তির! যে নাৎসি পার্টির নেতা এরকম একটা পিশে সে পার্টির কী মূল্য এই বেইমান পার্টিতে আস্থা রাখবে কোন দ্ৰ ইমানদার জর্মন এবং তুললে চলবে না, মাত্র বছর দুই পূর্বে গেলি রাউলও আত্মহত্যা করে। যদিও সে সময় কম্যুনিস্টরা সেই সুবর্ণ সুযোগের সিকি পরিমাণ ফায়দাও ওঠাতে পারেনি, অর্থাৎ একসপ্লয়েট করতে পারেনি।
কিন্তু মাভৈঃ! কন্দর্প নির্মিত এসব সংকটে প্রায়শ তিনি বিধাতার ন্যায়নীতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রেমিক-প্রেমিকার তাবৎ মুশকিল আসান করে দেন।
হফমান সঙ্গে সঙ্গে হিটলার তথা নাৎসি পার্টির জীবনমরণ সমস্যা সমাধান করে বললেন, নিশ্চিন্ত থাকুন। জানাজানি হয়নি। কারণ এফাকে অচৈতন্য অবস্থায় যে সার্জনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তিনি আমার নিকট-আত্মীয়। তাকে এমনভাবে কড়া পাহারায় রেখেছেন যে, পুলিশ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছতে পারেনি। তিনি স্বয়ং আমাকে খবরটা জানিয়েছেন।
তখন, এই প্রথম হিটলার প্রেয়সীর অবস্থা সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। না– ফাড়াকেটে গিয়েছে, তবে এফা রক্তক্ষরণহেতু বড়ই দুর্বল।
শুধু এফার ফাঁড়া কেটে গেল তাই নয়, স্বয়ং হিটলার এবং নাৎসি পার্টিরও ফাড়া কেটে গেল। অবশ্য কিছুটা কানাঘুষো হয়েছিল, কিন্তু জানাজানি হয়নি।
ব্যক্তিগত সম্পর্কে হিটলার যে খুবএকটা নেমকহারাম ছিলেন তা নয়। এই আত্মহত্যার প্রচেষ্টা থেকে হিটলার বুঝে গেলেন এফার প্রেম কতখানি গভীরবতার ব্রেন-বায়ে কিছু থাক আর না-ই থাক, তার গলা থেকে নাভিকুণ্ডলী অবধি জুড়ে বসে আছে একটা বিরাট যুদয় সেখানে না আছে ফুসফুল, না আছে লিভার সৃপ্লিন কিডনি না আছে অন্য কোনও যন্ত্রপাতি।
এ হেন হৃদয়কে তো অবহেলা করা যায় না।
এতদিন হিটলার যে প্রেম করতেন এফার সঙ্গে সেটার পদ্ধতি ছিল মোটামুটি জন কলেজ-স্টুডেন্টরা তাদের বান্ধবীর (ফ্রয়েভিন–গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে যেভাবে করে থাকে। অর্থাৎ সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর একা তার নাইটগাউন ইত্যাদি রাত্রের পোশাক একটি অতি ছোট্ট সুটকেসে পুরে চুপিসাড়ে ঢুকতেন হিটলারের ফ্ল্যাট বাড়িতে। বাড়ির পাঁচজন জেগে ওঠার পূর্বেই, ভোরবেলা, ফের চুপিসাড়ে চলে যেতেন আপন ফ্ল্যাটে।