গেলি হয়তো চিঠিখানা পেয়েছিল কিন্তু সে-চিঠি যে তার হৃদয়ে কোনও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল সে বিশ্বাস আমার হয় না। কারণ গেলিকে যিনি সবচেয়ে বেশি চিনতেন সেই হান বলেছেন, গেলি ভালোবাসত ভিয়েনাবাসী এক কলেজের ছোকরাকে, সে প্রকৃতপক্ষে কখনও তার মামার প্রেম নিবেদনের প্রতিদান দেয়নি। তদুপরি আরেকটি কথা আছে, হিটলার তখন গেলির প্রেমে অর্ধোদি। এফার সঙ্গে এমনি গতানুগতিক আলাপ হয়েছে। সে মজে গিয়ে হিটলারকে প্রেমপত্র লিখেছে- তরুণীরা আকছারই এরকম করে থাকে এবং হিটলার এ ধরনের চিঠি পেতেন গণ্ডায় গণ্ডায় এবং নিশ্চয়ই এফার এ চিঠি সিরিয়াসলি নেননি।
হিটলারের সঙ্গে এফার প্রথম পরিচয় হল হিটলার-সখা ফটোগ্রাফার হমানের স্টুডিয়োতে। মধ্যবিত্ত সমাজের কুমারী কন্যা যতখানি লেখাপড়া করে সেইটে সেরে তিনি হফমানের স্টুডিয়োতে অ্যাসিসটেন্টের কর্ম নেন। তার কাজ ছিল, খদ্দেরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা এবং ডার্করুমে কিছুটা সাহায্য করা। সেই সূত্রে হফমান নিতান্ত প্রফেশনালি হিটলারের সঙ্গে এফার আলাপ করিয়ে দেন।
হিটলারের কৈশোর ও প্রথম যৌবন কাটে ভিয়েনা নগরে। সে নগরের নাগরিকরা ডানসিং, ফ্লার্টিং, প্রণয়-মিলন, পরকীয়া শিভালরিতে অনায়াসে প্যারিসের সঙ্গে পাল্লা দেয়। হিটলারও রমণীসঙ্গ খুবই পছন্দ করতেন। জর্মনির সর্বময় কর্তা হওয়ার পর তিনি তার অন্তরঙ্গজনকে একাধিকবার গল্পচ্ছলে বলেছেন, এসব বড় বড় হোটেলের গাড়োলরা যে পুরুষ ওয়েটার রাখে, তার মতো ইডিয়টিক আর কী হতে পারে! এটা তো জলের মতো স্বচ্ছ যে, সুন্দরী যুবতী ওয়েট্রেস রাখলে ঢের ঢের বেশি খদ্দের জুটবে। আমার জীবনে ট্র্যাজেডি যে, রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে যখন আমি কোনও স্টেট-ব্যাঙ্গুয়েটে বসি, আমাকে বাধ্য হয়ে ডাইনে এবং বায়ে বসাতে হয় দুই বুড়ি-হাড়িকে। কারণ তাদের স্বামীরা দুই বুড়ো-হাবড়া রাষ্ট্রমন্ত্রী বা ভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি … ওহ, সে কী গযন্ত্রণা। খুশ-এখতেয়ার থাকলে তার বদলে আমি যে কোনও অবস্থায় ছোট্ট একটি নাম-নাজানা রেস্তোরাঁয় একটি উঁকি ওয়েট্রেসের সঙ্গে মেয়েদের বেতন কম বলে কন্টিনেন্টে ছোট রেস্তোরাঁই শুধু ওয়েট্রেস রাখে) দু-দণ্ড বসালাপ করতে করতে না হয় সামান্য ডাল-ভাতই (ওদের ভাষায় দুই পদী খানা) খাব–জাহান্নামে যাক স্টেট ব্যাঙ্গুয়েটের বাহান্ন পদি কোর্মা-কালিয়া, বিরয়ানি-তন্দুরি (ওদের ভাষায় শ্যাম্পেন কাভিয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি)।
তাই হিটলারের অ্যারোপ্লেনে রাখা হতো খাবসুরৎ হুরি, স্টুয়ার্ডেস। কিন্তু একথা সবাই বলেছেন, হিটলার উচ্ছল চরিত্রের লোক ছিলেন না।
এস্থলে নাগর পাঠককে সবিনয় নিবেদন করি, এফা ব্রাউন ছিলেন সত্য সত্যই চিত্তহারিণী অসাধারণ সুন্দরী। কিশোরী-যুবতীর সেই মধুর সঙ্গমস্থলে। কিন্তু এ-বেরসিক লেখক নারী-সৌন্দর্য বর্ণনে এযাবৎ বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি বলে নাগর রসিক পাঠককে এস্থলে সে রস থেকে সে বঞ্চিত করতে বাধ্য হল।
এফা সুন্দরী তো ছিলেনই তদুপরি স্টুডিয়োতে যেসব খানদানি বিত্তশালিণী তরুনী যুবতী ছবি তোলাতে আসতেন, এফা তাদের আচার-আচরণ থেকে অনেক কিছু শিখে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে তাদের বেশভূষা এবং অলঙ্কারাদি।… পরবর্তীকালে যখন তার অর্থের কোনওই অভাব ছিল না তখনও তার বেশভূষাতে রুচিহীন আড়ম্বরাতিশয্য প্রকাশ পায়নি। তাঁর অর্থবৈভব শুধু একটি অলঙ্কারে প্রকাশ পেত। তার বাঁ হাতে বাঁধা থাকত মহার্ঘ বিরল হীরেতে বসানো একটি ছোট্ট রিস্টওয়াচ। জনির মতো দেশের ফুরার যদি প্রিয়াকে তার জন্মদিনে একটি হাতঘড়ি উপহার দেন, তবে সেটি কী প্রকারের হবে, সেটা কল্পনা করার ভার আমি বিত্তশালী পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি।
গোড়ার দিকে হিটলার এফাকে খুব বেশি একটা লক্ষ করেননি।
এদিকে গেলির মৃত্যুর পর হিটলারের জীবন বড়ই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল।
সখা হফমান তখন তার চিত্তবিনোদনের জন্য সুযোগ পেলে হিটলারের প্রিয় অবসর যাপন পদ্ধতি অবলখন করতেন। হিটলারকে নিয়ে যেতেন মিউনিকের আশপাশের হ্রদবনানীতে পিকনিকে। সঙ্গে থাকতেন হমানের স্ত্রী, ফটো স্টুডিয়োর দু-একজন কর্মচারী এবং এফা ব্রাউন।
ক্রমে ক্রমে হিটলার শ্রীমতী এফা ব্রাউনের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন।
এর পর দেখা গেল, হমান যদি পক্ষাধিককাল কোনও পিকনিকের ব্যবস্থা না করতেন তবে স্বয়ং হিটলার তার ফ্ল্যাটে উপস্থিত হয়ে বলতেন, হেঁ হেঁ, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলুম, তাই আপনার এখানে ঢুঁ মারলুম। তার পর কিঞ্চিৎ ইতিউতি করে বলতেন, যা ভাবছিলাম… একটা পিকনিকের ব্যবস্থা করতে হয়, আপনারা তো আছেনই, আর হে হেঁ, ওই ফ্রলাইন ব্রাউনকে সঙ্গে নিয়ে এলেও মন্দ হয় না–কী বলেন?
তখনও হিটলার এফার প্রেমে নিমজ্জিত হননি এবং কখনও হয়েছিলেন কি না, সে-বাবদে আমার মনে গভীর সন্দেহ আছে। পরবর্তী কাহিনী পড়ে সুচতুর অন্তত আমার চেয়ে চতুর– পাঠক-পাঠিকা প্রেম বাবদে আপন আপন অভিজ্ঞতাপ্রসূত কূটবুদ্ধি দ্বারা আপন আপন সুচিন্তিত এবংকিংবা সহৃদয় অভিমত নির্মাণ করে নিতে পারবেন।
ইতোমধ্যে কিন্তু শ্রীমতী এফা হিটলার প্রেমের অতলান্ত সমুদ্রের গভীর থেকে গভীরতরে বিলীন হচ্ছেন। আর হবেনই-না কেন? যদ্যপি হিটলার তখনও রাষ্ট্রনেতা হননি, তথাপি তাবৎ জর্মনির সবাই তখন জানত, রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ যে কোনও দিন তাকে ডেকে বলবেন প্রধানমন্ত্রীরূপে দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে। তদুপরি, পূর্বেই বলেছি, হিটলার ছিলেন রমণীচিত্তহরণের যাবতীয় কলাকৌশলে রপ্ত।… এবং সর্বোপরি তিনি প্রায়ই অবরোবরে এফাকে দিতেন ছোটখাটো প্রেজেন্ট। বিত্তশালীজন তার দয়িতাকে যেরকম দামি দামি ফার কোট, মোটরগাড়ি দেয়, সেরকম আদৌ ছিল না–তিনি দিতেন চকলেট, ফুল বা ভ্যানিটি কেস (আমাগো রাষ্ট্রভাষায় যারে কয় ফুটানি কি ডিবিয়া)।