হিটলারের আপন মায়ের পেটের একটি সুন্দরী বোনও ছিল। তাঁকেও তিনি একবার তার বাড়ি বের্গহকে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি ওই বাড়ির আরাম-আয়েসে এতই সুখ পেলেন যে, কাটালেন মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘকাল। হিটলার বিরক্ত হলেন এবং শেষ পর্যন্ত বোনের বিদায় নেওয়ার পর তাকে আর কখনও নিমন্ত্রণ জানাননি। এ নদীর সঙ্গে এফা ব্রাউনের কলহ হয়েছিল কি না সে বিষয়ে ঐতিহাসিকরা নীরব। ভাইবোন বলতে ইনিই হিটলারের একমাত্র মায়ের পেটের বোন। তার বিখ্যাত ভ্রাতা আডলফ হিটলারের মৃত্যুর পরও অবহেলিত এই বোন কয়েক বৎসর বেঁচে ছিলেন।
এই আপন বোন ও পূর্বে বর্ণিত সেই সংদিদি ছাড়া হিটলারের ছিলেন একটি বৈমাত্রেয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, ওই সংদিদির বড় ভাই। নানা দেশে বহু কর্মকীর্তি করার পর ইনি এলেন বার্লিনে তাঁর সৎভাই জনির কর্ণধার হয়েছেন খবর শুনে। নাৎসি পার্টির দু-একজনকে চিনতেন বলে তাদের কৃপায় পারমিট জোগাড় করে খুললেন বার্লিনের উপকণ্ঠে একটা মদের দোকান বার। পার্টি-মেম্বাররা সেখানে যেতেন তো বটেই, তদুপরি বিশেষ করে সেখানে হুল্লোড় লাগাতেন দুনিয়ার যত খবরের কাগজের রিপোর্টার। ওনাদের মতলব, হিটলারের বাল্যজীবন সম্বন্ধে তস্য অগ্রজ ভ্রাতার কাছ থেকে গোপন তথ্য, রসালো চুটকিলা সংগ্রহ করে আপন আপন কাগজে টকঝাল পরিবেশন করা।
কিন্তু ব্রাদার আলওয়া হিটলার ছিলেন ঝাণ্ডু শুঁড়ি। পাছে তার কোনও বেফাঁস কথা কনিষ্ঠ ফুরার আডলফের কানে পৌঁছে যায় এবং তিনি চটেমটে তার মদের দোকানের পারমিটটি নাকচ করে দেন সেই ভয়ে তিনি ফুরার সম্বন্ধে একটিমাত্র কথা বলতে রাজি হতেন না। অনুজ যে কারণে-অকারণে ফায়ার হয়ে যান সেটা বড় বেরাদার বিলক্ষণ জানতেন।…হিটলারও তার সম্বন্ধে কখনও কোনও কৌতূহল দেখাননি।
পূর্বেই বলেছি, হিটলারের দাদা-দিদি-বোনের সঙ্গে তার যে কোনওপ্রকারের সম্পর্ক ছিল না, সেটা দিদি-বোনের পাড়াপ্রতিবেশী সখাসখী সবাই জানতেন। তাঁরাও সেটা আর পাঁচজনকে বলতেন। আহা! ফুরার জর্মনির ভবিষ্যৎ নিয়ে এমনই আকণ্ঠ নিমগ্ন যে তিনি তার আত্মীয়-স্বজন সম্বন্ধেও অচেতন। ক্রমে ক্রমে, গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে মৈত্র মহাশয় যাবে সাগরসঙ্গমে, এ স্থলে জর্মনির নগরে নগরে গ্রামে গ্রামে সংবাদটি রটে গেল, আবাল্য ব্রহ্মচারী জিতেন্দ্রিয় প্রভু হিটলার তার সব আত্মজনকে বিসর্জন দিয়ে একমাত্র জনির জন্য আত্ম-বিসর্জন দিচ্ছেন।
প্রপাগান্ডা মন্ত্রী গ্যোবেলস ঠিক এইটেই চাইছিলেন। তিনি সেই গুজবের দাবাগ্নিতে দিলেন ঘন ঘন কুলোর বাতাস। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ুক এ সত্য তত্ত্ব। বিশ্বজন আগের থেকেই জানত, হিটলারের জীবনধারণ পদ্ধতি ছিল চার্চিল এবং স্তালিন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। চার্চিলের মুখে জাগ্রতাবস্থায় সর্বক্ষণ অ্যাখোটা সিগার এবং বেলা-অবেলায় এক পেট খাঁটি স্কচ হুইস্কি। স্তালিনের ঠোঁটেও তদ্বৎ- তবে সিগারের বদলে খাঁটি রাশান পাপিসি (সিগারেট) এবং স্কচের বদলে তিনি অষ্টপ্রহর পান করতেন, হুইস্কির চেয়েও কড়া মাল ভোদকা শরাব। দুজনই সর্ববিধ গোশত গব গব করে গিলতেন। পক্ষান্তরে হিটলার ধূম্র এবং মদ্যপান করতেন না এবং তিনি ছিলেন ভেজিটারিয়ান। কাজেই তাকে জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারীরূপে বিশ্বজনের সম্মুখে তুলে ধরতে ড. গ্যোবেলুসের কল্পনার আশ্রয় অত্যধিক নিতে হয়নি।
হিটলারের মৃত্যুসংবাদ জর্মন জনগণকে যে শক দিয়েছিল, তার পর তারা যে মোক্ষমতর শ পেল তার সঙ্গে এটার কোনও তুলনাই হয় না।
যুদ্ধ-শেষে কয়েকদিন পর (মে ১৯৪৫) যে রুশ সেনাপতি জুকফ বার্লিন অধিকার করে তিনি প্রচার করলেন, আত্মহত্যা করবার পূর্বে হিটলার তার এক রক্ষিতাকে বিয়ে করেন।
সর্বনাশ! বলে কী! সেই জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারী যিনি
দারাপুত্র পরিবার
কে তোমার তুমি কার?
কিংবা কা তব কান্তা কত্তে পুত্রঃ ধ্যানমন্ত্রস্বরূপ গ্রহণ করে সুদীর্ঘ পঞ্চবিংশ বৎসর জর্মনির জন্য বিদ্রি ত্রিযামা যামিনী যাপন করলেন তিনি কি না শেষ মুহূর্তে ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্যবশত ধর্মচ্যুত হয়ে বিবাহ করলেন একটা রক্ষিতাকে! এ যে মস্তকে সর্পদংশন।
আজ যদি শুনতে পাই (এবং এটা অসম্ভব তথা আমি মাপ চেয়ে নিয়ে বলছি) যে ডিউক অব উইনজার তার দয়িতার সঙ্গে পরিপূর্ণ মিলনার্থে অবহেলে ইংলন্ডের সিংহাসন ত্যাগ করেন, তিনি তার সেই বিবাহিতা পত্নীকে ত্যাগ করে প্যারিসের কোনও গণিকালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তবে কি সেটা পয়লা ধাক্কাতেই বিশ্বাস করব।
জর্মনির জনসাধারণ প্রথমটা এ সংবাদ বিশ্বাস করতে চায়নি।
কিন্তু ব্যাপারটা তখন দাঁড়িয়েছে এই; যতক্ষণ ম্যাজিশিয়ান তার ভানুমতি খেল দেখায় ততক্ষণ দর্শক বেবাক নির্বাক হয়ে তাই দেবে, কিন্তু যে মুহূর্তে বাজিকর গুড নাইট বলে অন্তর্ধান করে তনুহূর্তেই আরম্ভ হয় বিপুল কলরব। কী করে এটা সম্ভব হল, কী করে এটা সম্ভব হল?–তাই নিয়ে তুমুল বাক-বিতণ্ডা! এবং দু-একটি লোক যারা ম্যাজিকের সঙ্গে কিছু কিছু পরিচিত তারা অল্পবিস্তর পাকা সমাধানও তখন দেয়।
এ স্থলেও তাই হল। হিটলার ম্যাজিশিয়ান যখন তার শেষ খেল দেখিয়ে ইহলোক থেকে অন্তর্ধান করলেন তখন আরম্ভ হল তুমুলতর অট্টরোল। এবং এ স্থলেও যারা হিটলারের অন্তরঙ্গজন– হিটলারি ম্যাজিকের অর্থাৎ এফা ব্রাউনের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জানতেন– তারা এ বাবদে ঈষৎ ছিটেফোঁটা ছাড়তে আরম্ভ করলেন। এঁদের কাহিনী অবিশ্বাস করার উপায় ছিল না।