১৭ অক্টোবর ১৯৪১-এ জরগে গ্রেফতার হন। ঠিক তার ৩২ দিন পূর্বে কনোয়ে মন্ত্রিত্ব পদে ইস্তফা দেন। এ দুটোতে কোনও যোগসূত্র আছে কি না আমার কাগজপত্র কেতাবাদি সে সম্বন্ধে নীরব। আমার মনে হয় পুলিশ কোনও গুপ্তচর সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়ামাত্রই তাকে গ্রেফতার করে না। বেশ কিছুদিন তাকে অবাধে চলাফেরা করতে দেয়। তার সহকর্মী চরদের চিনে নেয়। তার পর এক শুভ প্রভাতে বিরাট পেয়াজাল ফেলে সবকটা মাছ ধরে। ইতোমধ্যে কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান কনোয়েকে অবশ্যই জানানো হয়েছে যে, তার বিশ্বাসী ওসাকিই অশেষ পাপের পাপী পঞ্চম পাতকী। তার চেয়ে বেশি পাপী বিশ্বাসঘাতকী।
এত বড় কেলেঙ্কারির পর প্রধানমন্ত্রী থাকা যায় না। কনোয়ের রাজনৈতিক জীবন এখানেই চিরতরে খতম। ১৯৪৫-এ তিনি আত্মহত্যা করেন। কনোয়ে ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি খানদানি উচ্চকর্মচারীকে, জরগের নির্দেশে ওসাকি পারদর্শিতার সঙ্গে দিনের পর দিন পাম্প করেছিলেন।
সামসনের মতো জরগে পুরো এমারত ধূলিসাৎ না করতে পারলেও জাপান রাষ্ট্রের ভিতে যে ফাটল ফাটিয়ে যান সেটা কখনও মেরামত হয়নি।
———-
১. কোনও ফিলাটেলিস্ট পাকা খবর জানালে বাধিত হব।
২. শ্রদ্ধেয় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী-লেখকের উপকারার্থে মসলা নিবেদন। একখানা বৃহৎ ব্যাকরণ রচনা করার কয়েক বৎসর পর তিনি তারই একখানি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেন। আমার সঙ্গে দেখা হলে পর দুষ্টু হাসি হেসে বললেন, এটা হল সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণ; আগেরটা ছিল ক্ষিপ্ত ব্যাকরণ।
হিটলারের শেষ প্রেম
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১ মে রাত দশটার সময় হামবুর্গ বেতার কেন্দ্র তার উচ্চাঙ্গ সংগীত প্রোগ্রাম হঠাৎ বন্ধ করে দিয়ে ঘোষণা করলো–
আমাদের ফুরার আডলফ হিটলার বীরের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
যে সময়ে এ নিদারুণ ঘোষণাটি করা হয়, তখন প্রোগ্রামমাফিক কথা ছিল, ইঁদুর ধ্বংস করার উপায়। এই নিয়ে হিটলার-বৈরীরা এখনও ঠাট্টা-মশকরা করেন।
যেসব জর্মন বেতার-ঘোষণাটি শুনেছিল, তাদের অনেকেই যে বিরাট শক পেয়েছিল, সে নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এদের অনেকেই সরলচিত্তে বিশ্বাস করত, আশা রাখত–যে হিটলার ক্রমাগত পঁচিশ বৎসর বহু উৎকৃষ্ট সংকটে যেন ভাগ্যবিধাতার অদৃশ্য অঙ্গুলি সংকেতে, অবলীলাক্রমে বিজয়পতাকা উড্ডীয়মান করে সেসব সংকট উত্তীর্ণ হয়েছেন, এবারেও তিনি আবার শেষ মোক্ষম ভেল্কিবাজি দেখিয়ে তাবৎ মুশকিল আসান করে দেবেন। তার অর্থ; যেসব রুশ-সৈন্য বার্লিন অবরোধ করেছে তারা স্বয়ং হিটলারচালিত আক্রমণে খাবে প্রচণ্ডতম মার, ছুটবে মুক্ত হয়ে মস্কো বাগে। সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন-ইংরেজ সৈন্যও পড়ি-মরি হয়ে ফিরে যাবে আপন আপন দেশে। রাহমুক্ত ফুরার পথপ্রদর্শক সর্বোচ্চ নেতা পুনরায় ইয়োরোপময় দাবড়ে বেড়াবেন।
এরা যে মোক্ষম শ পেয়েছিল সে তো বোঝা গেল। কিন্তু তার চেয়েও মোক্ষমতর শক্ পেল কয়েকদিন পর, যখন বেতার ঘোষণা করল, হিটলার আত্মহত্যা করার পনেরো ঘণ্টা পূর্বে এফা ব্রাউন নামক একটি কুমারীকে বিয়ে করেন। কারণ, জর্মনির দশ লক্ষের ভিতর মাত্র একজন হয়তো জানত যে, হিটলারের একটি প্রণয়িনী আছেন এবং তার সঙ্গে তিনি স্বামী-স্ত্রীরূপে বছর বারো-তেরো ধরে জীবনযাপন করছেন। নিতান্ত অন্তরঙ্গ যে কয়েকজন এই গুপ্তি প্রেমের খবর জানতেন, তারা এ বাবদে ঠোঁট সেলাই করে কানে ক্লফর্ম ঢেলে পুরো পাক্কা নিশ্চুপ থাকতেন। কারণ হিটলারের কড়া আদেশ ছিল, তার এই গুপ্তিপ্রেম সম্বন্ধে যে-কেউ খবর দেবে বা গুজব রটাবে, তিনি তার সর্বনাশ করবেন। তার কারণও সরল। তাঁর প্রপাগান্ডা মিনিস্টার গ্যোবেলস দিনে দিনে বেতারে খবরের কাগজের মারফতে হিটলারের যে মূর্তি গড়ে তুলেছিলেন (আজকের দিনের ইংরেজিতে তার যে ইমেজ নির্মাণ করেছিলেন সেটি সংক্ষেপে এই : হিটলার আজীবন ব্রহ্মচারী, তার ধ্যানধারণাসাধনা সর্বশক্তি তিনি নিয়োগ করেন, একমাত্র জর্মনির মঙ্গলসাধনে, হিটলার স্বয়ং অন্তরঙ্গ জনকে একাধিকবার বলেছেন, জর্মনিই আমার বধু (বাগদত্তা দয়িতা)। এমনকি তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরও তত্ত্বতাবাশ করেন না। এটা সত্য, এ নিয়ে কোনও ঢাক ঢাক গুড় গুড় ছিল না। গোড়ার দিকে তিনি তাঁর বিধবা একমাত্র সদিদিকে মিউনিকের নিকটবর্তী তার বেৰ্ষটেশগার্ডেনের বাড়ি বের্গহকে গৃহকত্রীরূপে রাখেন। কিন্তু কিছুকালের মধ্যে সে বাড়িতে এসে পৌঁছলেন এফা ব্রাউন। যা আকছারই হয়- ননদিনী-ঠাকুরঝির সঙ্গে লাগল কোদল। হিটলারের অন্যতম বন্ধু বলেন, এস্থলে আরও আকছারই যা হয় তাই হল। পুরুষমানুষ, তায় হিটলারের মতো কর্মব্যস্ত পুরুষ, এসব মেয়েলি কোঁদলে কিছুতেই প্রবেশ করে একটা ফৈসালা করে দিতে সম্পূর্ণ নারাজ। তিনি চুপ করে বসে যাত্রাগান দেখলেন–অবশ্য অতিশয় বিরক্তিভরে। শেষটায় দিদিই হার মানলেন। হিটলার-ভবন ত্যাগ করে মিউনিকে আপন একটি ছোট্ট বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। হিটলার এর পর তাকে আর কখনও তার নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেননি। তার কিছুদিন পর সৎদিদি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। হিটলার এটাতে ভয়ঙ্কর চটে যান। কেন, তা জানা যায়নি। বিবাহ-উৎসবে উপস্থিত তো হলেনই না, সামান্য একটি প্রেজেন্টও পাঠালেন না। উভয়ের মধ্যে যোগসূত্র চিরতরে সম্পূর্ণ ছিন্ন হল।