জরগের চেহারাটি ছিল সুন্দর এবং পুরুষত্বব্যঞ্জক। দীর্ঘ বলীয়ান দেহ। নাক চোখ ঠোঁট যেন পাথরে খোদাই অতি তীক্ষ্ণ। তাঁকে দেখে মনে হতো যেন চ্যাম্পিয়ন বক্সার বিরাট কোনও মেলাতে চ্যালেঞ্জ করে বেড়াচ্ছেন, কেউ তার সঙ্গে লড়তে রাজি আছে কি না–
বলছেন এরিষ করট, জাপানে অবস্থিত জর্মন রাজ-দূতাবাসের দুই নম্বরের কর্মচারী। অবশ্য টোকিয়োতে তিনি সবাইকে চ্যালেঞ্জ করতেন তর্কযুদ্ধে এবং জিততেন হামেশাই। কারণ তার তূণীর ভর্তি থাকত তথ্যের লেটেস্ট ইনটেলিজেন্সের শরচ্ছে। অর্থাৎ নেকেড় ফ্যাক্টস।
সেই যে গল্প আছে, গ্রামাঞ্চলের দুই ইরাকি জমিদার মোকদ্দমা লড়তে লড়তে আপিল করেছেন বাগদাদের শেষ আদালতে অর্থাৎ স্বয়ং খলিফা হারুন-উর-রশিদ এর শেষ ফাইনাল বিচার করবেন। এক জমিদার বাগদাদে এসে উঠলেন তার সখা বাদশার প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদে। প্রতিবাদী উঠলেন তার বাল্যের বান্ধবী বাদশার খাস প্যারা রক্ষিতার বাড়িতে। বাদী মোকদ্দমা হেরে গ্রামে ফিরলে পর সবাই বিস্ময় মেনে শুধোল, প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে উঠেও আপনি মোকদ্দমার সুরাহা করতে পারলেন না? তিনি বিজ্ঞজনোচিত কণ্ঠে বললেন, তাঁরা যে উঠেছিলেন রাজরক্ষিতার বাড়িতে। আমার কোনও যুক্তি কোনও নজির দাঁড়াতে পারে উলঙ্গ যুক্তির বিরুদ্ধে, এগেনস্ট নেকেড আরগুমেন্ট!
জরগের বেশভূষা ছিল অপরিপাটি; তিনি বাস করতেন টোকিওর সবচেয়ে খাঁটির খাঁটি ঘিঞ্জি জাপানি মহল্লায় এবং বাড়িটা চোখে পড়ার মতো নোংরা। কিন্তু জাপানিদের আকর্ষণ করার মতো কেমন যেন একটু চুম্বকের শক্তি তার সর্বাঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত হত। তারা তাকে পুজো করত বললে কমই বলা হয়। এদিকে তার চালচলন ছিল ভ্যাগাবন্ড, বেদে বা বোহেমিয়ান ধরনের। রমণীবাজি করতেন প্রচুর এবং মদ্যপান করতেন বেহ। তিনটে বোতল হুইস্কি ঘণ্টা কয়েকের ভিতর সাবড়ে দিতেন তিনি অক্লেশে- চোখের পাতাটি না কাঁপিয়ে এবং তাঁর চোখের সেই তীক্ষ্ণ জ্যোতিটির উপর সামান্যতম ঘোলাটে পৌঁছ পড়ত না।
অর্থাভাব তার লেগেই থাকত। ধরা পড়ার পর অনুসন্ধান করে জানা যায়, তার আমদানি যে কোনও মাঝারি রাজ-দূতাবাসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের মতো অতি সাধারণ। পরিষ্কার বোঝা যায়, তিনি কখনও তার স্পাইবৃত্তি এক্সপ্লয়েট করেননি। তিনি স্পাই হয়েছিলেন কম্যুনিজমের প্রতি তার আন্তরিক আদর্শবাদে প্রবুদ্ধ হয়ে।
জরগে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন রুশ এবং জনি উভয় দেশে। তার স্বৰ্গত ঠাকুর্দা ছিলেন কার্ল মার্কসের সেক্রেটারি। শিক্ষা সমাপনান্তে, প্রথম যৌবনে, এ শতকের দ্বিতীয় দশকে তিনি পশ্চিম জর্মনিতে একটি কম্যুনিস্ট পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। অতঃপর তাঁকে তৃতীয় ইন্টারনেশনালের বৈদেশিক গুপ্তচর বিভাগে কর্ম দিয়ে স্কানডিনেভিয়া ও পরে তুর্কিতে গুপ্তচরবৃত্তি করতে পাঠানো হয়। তুর্কিরা এসব বাবদে অসাধারণ চালাক। গন্ধ পেয়ে যায়। অচিরায়। জরগে কিয়ৎকাল জেল খাটলেন– তার গুপ্তচরবৃত্তিতে এই একটিমাত্র কলঙ্ক; সর্বসাধারণ অবশ্য যুদ্ধশেষের অনেক পরে এসব জানতে পায়। ১৯৩০ সালে রুশ সরকারের আদেশে তাকে পাঠানো হয় সাংহাইয়ে। এখান থেকে আরম্ভ হয় তার কৃতিত্বময় জীবন। …জরগেকে যে জাপানি কোর্ট মারশালের সামনে দাঁড়াতে হয় সে মোকদ্দমার নথিপত্র মার্কিনরা জাপান অধিকার করার পর হস্তগত করে। তার থেকে জানা যায়, জরগে সাংহাইয়ে যেসব দেশি-বিদেশি কম্যুনিস্টদের সংস্পর্শে আসেন তাদের অন্যতম হজুমি ওসাকি নামের জনৈক জাপানি। এরপর এরা মস্কোর আদেশে টোকিও চলে আসেন।
প্রকাশ্যে তার পেশা ছিল নাৎসি-নির্দেশচালিত (অবশ্য তখন তাবৎ জর্মন প্রেসই গ্যোবেলসের কজাতে) ফ্রাঙ্কফুর্টের আলগে-মাইনে সাইটুঙের সংবাদদাতারূপে। তবে তাঁর অনেক প্রবন্ধই ছাপাবার মতো সাহস সম্পাদকমণ্ডলীর ছিল না। তারা সেগুলো না ছেপে চেপে যেতেন। সহকর্মীরূপে তাঁকে ক্লাউজেন নামক আরেক জর্মন গুপ্তচর দেওয়া হয়েছিল। প্রকাশ্যে তাঁর ব্যবসা ছিল মোটর মেরামতি। ওদিকে ছিলেন সেরার সেরা রেডিয়োর ওস্তাদ। অবশ্য জাপান থেকে কুশের পূর্বতম সীমান্তে রেডিয়োবার্তা পাঠাতে জোরদার ট্রান্সমিটারের দরকার হয় না– ধরা পড়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম। ক্লাউজেনও ধরা পড়েছিল কিন্তু তাকে জাপানিরা ফাঁসি দেয়নি; যুদ্ধশেষে রুশ দেশে ফিরে যাবার অনুমতি দেয়।
জরগে যখন ধরা পড়লেন এবং সামান্যমাত্র অনুসন্ধানের ফলে জানা গিয়েছে তিনি বাঘা স্পাই, তখনই জাপান মন্ত্রিমণ্ডলী বিশ্বয়ে হতবাক। এ যে একেবারে অবিশ্বাস্য! এইমাত্র যে জাপানি হজুমি ওসাকির নাম বললুম সে লোকটি কী করে হয়ে গিয়েছিলেন প্রিন্স কনোয়ের সাতিশয় বিশ্বাসভাজন সহকর্মী। এই কনোয়েটি যে-সে ব্যক্তি নন। একে তো জাপানের তিন-চারটি খানদানিতম ঘরের একটির প্রিন্স ডিউক, তদুপরি তিনি তিন-তিনবার জাপানের প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন– এঁর আদেশেই জাপান ত্রিশক্তি চুক্তিতে যোগ দেয়, হিটলার ও মুসসোলিনির সঙ্গে এবং এরই রাজত্বকালে পাকা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। যদিও ঘোষণা করা হয় তার পদত্যাগের পরে। এবারে পাঠক তারিখগুলো লক্ষ করবেন। ১৯৪০-এর জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ পর্যন্ত (ক্যাবিনেট পুনর্গঠনের জন্য মাত্র দুটি দিন বাদ দিয়ে) কনোয়ে ছিলেন জাপানের সর্বময় কর্তা এবং হজুমি ওসাকি ছিলেন তাঁর পরম বিশ্বাসী অন্তরঙ্গজন। বলা বাহুল্য গোপন মন্ত্রণাসভার আলোচনা–সিদ্ধান্ত ওসাকি কনোয়ের কাছে পেয়ে কমরেড জরগেকে গরম-গরম সরবরাহ করতেন এবং এই চোদ্দ মাসেই জাপানের এ যুগের ইতিহাসে সবচেয়ে মোক্ষম-মোক্ষম মরণ-বাচন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় (হিটলারের সঙ্গে দোস্তি, মার্কিনের সঙ্গে লড়াই)। একেবারে গাঁজাখুরি অবিশ্বাস্য ঠেকে যে, হিটলার-সখা কনোয়ের পরম বিশ্বাসী সহচর ছিলেন হিটলারবৈরী রুশের গুপ্তচর এবং তিনি জাপানের গোপনতম সিদ্ধান্ত স্তালিনকে পাঠাচ্ছেন হিটলারের বিনাশসাধনের জন্য। এবং হিটলার বিনষ্ট হলে যে আপন মাতৃভূমি জাপানের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী সে তত্ত্বটি বোঝার মতো এলেম নিশ্চয়ই এই ঝানু গুপ্তচরের পেটে ছিল। তিনি নাকি গুপ্তচরবৃত্তিতে তালিম পেয়েছিলেন জরগের কাছ থেকে। জরগে যে স্পাইদের গুরুর গুরু সেকথা তো পূর্বেই বলেছি।