জরগের জীবন এমনই বৈচিত্র্যময় এবং ঘটনাবহুল যে, সুদ্ধমাত্র তার সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিতে গেলেই একখানা মিনি সাইজের মহাভারত লিখতে হয়।… আমি গুপ্তচর জরগেকে নিয়ে গুপ্ত পদ্ধতিতে দিব্য একখানা রগরগে সিরিয়াল লিখতে পারি- যত কাঁচা ভাষা ততোধিক বেটপ শৈলীতে লিখলেও বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যবশত সেটা উৎরে যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু বয়স হয়েছে। আমার জীবনদুর্গে প্রাচীরের বাইরে, গভীর রাত্রে যমদুতের পদধ্বনি প্রায়ই নতে পাই। মাঝে মাঝে ইদানীং ক্রমেই টেম্পো বেড়ে যাচ্ছে-প্রাচীরের উপর সাহেবি কায়দায় নকুও করে। এহেন অবস্থায় সিরিয়াল অসম্পূর্ণ রেখে উল্টোরথহীন রথযাত্রায় বেরুতে চাইনে–মমেকসদয় সম্পাদকমণ্ডলীকে ক্ষিপ্ত পাঠক সম্প্রদায়ের অভিসম্পাতকুণ্ডে নিমজ্জিত করে। কাজেই সম্ভাব্য ক্ষিপ্ত পাঠকমণ্ডলীর জন্য সংক্ষিপ্ত পাঠ দিচ্ছি– সাতিশয় সংক্ষিপ্ত (২)
দুই কারণে সোভিয়েত দেশ জরগের কাছে চিরঋণী। অবশ্য রুশের আরও বহু সেবা তিনি করেছেন।
প্রথম : হিটলার রুশদের আক্রমণ করার বেশ কয়েক মাস অর্থাৎ পর্যাপ্তকাল পূর্বে জরগে জাপান থেকে গোপন বেতারযোগে (বেতারযন্ত্রটি চালাতেন তার এক সহ-স্পাই) স্তালিনকে খবর পাঠান, হিটলার চুক্তিভঙ্গ করে রুশ আক্রমণ করবে। শুধু তাই নয়, কোন মাসে, কোন সপ্তাহে সে খবরও পাকাপাকিভাবে জানান। আশ্চর্য, যখন খুদ জর্মনির মাত্র গুটিকয়েক ডাঙর ডাঙর জাদরেল জানতেন যে হিটলার রুশ আক্রমণ করার জন্য সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেছেন এবং তারাও জানতেন না, কবে কোন মাসে হিটলার সে হামলা শুরু করবেন, তখন জর্মনি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের জাপানে বসে জরগে এই পাকা খবরটি পেলেন কী করে? মনে রাখা উচিত, ১৯৩৯-এ যুদ্ধার পর থেকে জাপান এবং জর্মনির মধ্যে কোনও যাতায়াত পথ ছিল না। (সুভাষচন্দ্র যে কতখানি বিপদের ঝুঁকি মাথায় তুলে জর্মনি থেকে জাপান পাড়ি দিয়েছিলেন সেকথা সবাই জানেন।) সুইজারল্যান্ড থেকে গোপন বেতারেও যেমন মনে করুন খবরটা প্রথম জনি থেকে নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ডে গুপ্তচর মারফত গেল– সেটা পাঠানো প্রায় অসম্ভব ছিল। ওরকম বেআইনি জোরদার বেতার ট্রান্সমিটার সুইস সরকার ধরে ফেলতই ফেলত। এস্থলে আরও বলি, হিটলার তার যুদ্ধের প্ল্যান তার দূর-মিত্র জাপানকে তো বলতেনই না, তার অতিশয় নিকট-মিত্র ভৌগোলিক ও হার্দিক উভয়ার্থে মুসসোলিনিকেও আগেভাগে জানাতেন না। এবং জাপানে অবস্থিত জর্মন রাজ-দূতাবাসও আর-পঞ্চাশটা দেশে অবস্থিত জর্মন রাজ-দূতাবাসের মতোই যে এ ব্যাপারে কিছুই জানত না সে তো বহু ক্ষেত্রে সপ্রমাণ হয়ে গেছে। হিটলার যে তার ফরেন আপিস এবং তাঁর রাজদূতদের অবিশ্বাস করতেন তাই নয়, এদের রীতিমতো ঘৃণা করতেন। এবং এ তত্ত্বটি হিটলার কোনওদিন গোপন রাখার কণামাত্র প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র তার আপন খাস প্যারা ফরেন মিনিস্টার রিবেট্রপকে। ইনি জাতে শুড়ি। কূটনীতিতে তার কোনও শিক্ষাদীক্ষা বা অভিজ্ঞতা ছিল না। তত্সত্ত্বেও হিটলার গদিনশিন হওয়ার সামান্য কয়েক বৎসর পর তার পার্টি, ফরেন আপিস, এমনকি তার দক্ষিণ হস্ত গ্যোরিঙ, বাম হস্ত গ্যোবেলস সক্কলের তীব্র প্রতিবাদ উপেক্ষা করে রিবেট্রপকে দুম করে বসিয়ে দিলেন ফরেন আপিসের মাথার উপর মহামান্য পররাষ্ট্র সচিবরূপে।
জরগের দ্বিতীয় অবদান : যে রাত্রে জাপানি মন্ত্রিসভা এক অতিশয় গোপন বৈঠকে স্থির করলেন হিটলার রুশ আক্রমণ করার পর জাপানকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান, তারা যেন রুশের পূর্বসীমান্ত আক্রমণ করে যে তারা কোনও অবস্থাতেই রুশ দেশ আক্রমণ করবেন না, তার পরদিন ভোরবেলা জরগে সেই সাতিশয় গুরুত্বপূর্ণ গোপনতম সিদ্ধান্তটির বর পেয়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে স্তালিনকে পূর্ব পদ্ধতিতে সংবাদটি জানান। স্তালিনের বুকের উপর থেকে জগদ্দল জগরনট নেমে গেল। জাপানি আক্রমণের ভয়ে পূর্ব সীমান্তে ভার যে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল সেটাকে তদ্দশ্যেই পশ্চিম সীমান্তে এনে হানলেন হিটলারের উপর মোক্ষম হামলা। দুই সীমান্তে একইসঙ্গে কে লড়তে চায়? ওই করে সর্বনাশ হল কাইজারের। হিটলারেরও আখেরে সেই গতিই হয়েছিল। রুশ বেঁচে গেল।
পত্রান্তরে বেরিয়েছে : গত ৬ নভেম্বর পূর্ব জনির পূর্ব বার্লিনের একটি রাস্তার উপর প্রাক্তন রুশ স্পাইদের একটি সম্মিলিত অনুষ্ঠান হয় প্রকাশ্যে। রয়টার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন : স্পাইদের সম্মেলন– তা-ও প্রকাশ্যে।
এরা সমবেত হয়েছিলেন তাদের গুরুর গুরু জরগের স্মরণে।
পঁচিশ বৎসর পূর্বে বিশ্ব কনিজমের জন্য টোকিয়োতে প্রাণ দেন।
যে রাস্তাতে ভঁরা সমবেত হন সেখানে সেনাবাহিনীর ব্রাসব্যান্ডের সঙ্গীতসহ রাস্তাটির নতুন নামকরণ হয়।
রিষার্ট জরগে স্ট্রাসে।
.
রিষার্ট জরগে খাঁটি জর্মন নাম। রিষার্টের পিতা ছিলেন খাঁটি জর্মন, মা রুশ। জরগের জন্ম রুশদেশে। জাপানে থাকাকালীন জরগে সর্বজনসমক্ষে বলতে কসুর করতেন না যে, রুশের প্রতি তার বিশেষ শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি আছে। তৎসত্ত্বেও কেউ কখনও সন্দেহ করেননি যে তিনি রুশের শাই, অতখানি কী করে হয়। এদিকে তার মূল কর্ম ছিল জাপান সম্বন্ধে স্তালিনকে খবর দেওয়া এবং দ্বিতীয় সেই সুদূর জাপান থেকে জর্মনির অভ্যন্তরীণ গুপ্ত খবরও সহ করে তাকে জানানো কী করে তিনি সংগ্রহ করতেন সেটা প্রাশাটে (প্ল্যানচেটে) শার্লক হোমসকে আবাহন জানালে হয়তো জানা যেতে পারে। জরগে ধরা পড়ার পর জাপানে প্রবাসী জর্মন-অজর্মন সবাই একবাক্যে বলেছেন, জরগে কস্মিনকালেও তাদের কাছ থেকে জর্মনি সম্বন্ধে কোনও খবরাখবর পাম্প তো করতেনই না, উল্টো নয়া নয়া খবর দিয়ে তাদের পিলে চমকে দিতেন; পরে সেগুলো কনফারড হত।