এই চূড়ান্তে পৌঁছে যক্ষ হঠাৎ থেমে গিয়ে আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে রইলেন।
সাংসারিক বুদ্ধি আমার ঘটে আছে, এহেন অপবাদ যেসব পাওনাদারদের আমি নিত্যি নিত্যি ফাঁকি দিয়ে অদ্যাবধি বেঁচেবর্তে আছি তারাও বলবেন না। তৎসত্ত্বে এ নাটকের শেষাঙ্কে আমি যেন অকস্মাৎ অর্জুনের দিব্যদৃষ্টি প্রসাদাৎ কৃষ্ণাবতারের বিশ্বরূপ দেখতে পেলুম।
সংক্ষেপে বলিতে গেলে হিং টিং ছট! অর্থাৎ পূর্বোক্ত দলিলে আমাকে জাল করতে হবে কবির সিগনেচর, স্বাক্ষর, দস্তখত। দস্ত কথা শব্দটির অর্থ হাত (যার থেকে দস্তানা এসেছে); আমাকে দস্তখত করতে হবে না, করতে হবে দক্ষত অর্থাৎ জাল করে হাতে ক্ষত আনতে হবে।
আমার মুখে কোনও কথা যোগাল না।
যক্ষ বললেন, আপনার দক্ষিণা কী পরিমাণ হবে?
আমার মাথায় তখন নলজিদেহনির্গত কলি ঢুকেছে, অর্থাৎ দুষ্টবুদ্ধি চেপেছে। দেখিই না, শ্রাদ্ধ কতদূর গড়ায়।
ব্ৰীড়াময়ী কুমারীর মতো কিংবা ধোয়া তুলসীপাতাটির মতোও বলতে পারেন ক্ষিতিলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিবেদন করলুম, আপনি বলুন।
সঙ্গে সঙ্গে না তাকিয়েই অনুত্ব করলুম যক্ষের সর্বাঙ্গে শিহরণ রোমাঞ্চন উত্তাল তরঙ্গ তুলেছে। এত সহজে যে নিরীহ একটা লেখক এহেন ফেরেব্বাজিতে রাজি হবে, এ দুরাশা তিনি আদপেই করেননি। ভেবেছিলেন আমাকে বহুং উলাইমলাই করতে হবে। সোল্লাসে বললেন, পাঁচশো।
আমি তুলসীপাতার কোমল রূপটি সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করে সুতীক্ষ্ণ তালপাতার আকার ধারণ করে বললুম, আপনি কি ছাগীর দরে হাতি কিনতে চান তার চাইতে যান না যে কোনও আদালতের সামনে বটতলায়। পাকা জালিয়াত পাঁচটি টাকায় ওই কর্মাট করে দেবে!
আমার চাই পাঁচ হাজার।
আমি বেশ বুঝে গিয়েছিলুম, যক্ষ প্রফেশনাল জালিয়াতের কাছে যেতে চান না। সেটা মোস্ট ডেনজরস।
ইতোমধ্যে এই প্রথম তার পরিপূর্ণ সপ্রতিভ ভাব কেটে গিয়ে তিনি হয়ে গেছেন স্তম্ভিত হতভম্ব। কিছুক্ষণ পরে রাম ইডিয়টের মতো বিড়বিড় করে বললেন, পাঁচ হাজার
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললুম, বড়বাজারের নাপিতকে দিয়ে আপনার কান সাফ করাতে হবে না। ঠিকই শুনেছেন।
অতঃপর গৃহমধ্যে সূচিভেদ্য নৈস্তব্ধ।
খানিকক্ষণ পর আমিই বললুম, আপনি বাড়ি গিয়ে চিন্তা করুন, স্লিপ ওভার ইট। আমিও তাই করব।
আমি জানতুম, এসব ঘড়েলদের সবচেয়ে বড় গুণ এদের ধৈর্য। তাই এই ধৈর্য কাজে লাগাবার ফুরসত-মোকা পেলেই এরা সোল্লাসে রাজি হয়। ধৈর্য দ্বারা ঘষতে ঘষতে এরা অন্যপক্ষের প্রস্তরও ক্ষয় করতে পারে।
আর আমারও তো কোনও স্টক নেই। এদের ধৈর্য যদি অফুরন্ত হয়, তবে আমার ধৈর্য অনন্ত। দেখাই যাক না, শ্রাদ্ধ কদ্দুর গড়ায়।
.
তাই গোড়াতেই বলছিলুম আমাদের মতো নগণ্যগণও এসব ছিটেফোঁটার সুযোগ পায়, কিন্তু হায়, যার অদৃষ্টে অর্থ নেই তার কপালে স্বয়ং মা-লক্ষ্মী ঠাকুরানিও ফোঁটা আঁকতে এলে সে মূর্খ তখন যায় নদীতীরে, কপাল ধুতে। ফিরে এসে দেখে, লক্ষ্মী অন্তর্ধান করেছেন। তাই তার নাম চপলা!
স্পাই
আশ্চর্য!
মানুষ কত সহজে বিশ্বখ্যাত লোককে ভুলে যায় বিশ্ববিখ্যাত লোককে ভোলাটা মানুষের পক্ষে অবশ্যই স্বাভাবিক।
মাতা হারিকে সচরাচর পৃথিবীর লোকে পয়লা নম্বরি পাই খেতাব দিয়েছে কিন্তু অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, সে খ্যাতির চৌদ্দ আনা পরিমাণ গুজব আর কিংবদন্তির ওপর নির্ভর করছে। বাকি দু-আনাও বিশ্বাসযোগ্য কি না বলা কঠিন।
কিন্তু গত বিশ্বযুদ্ধের স্পাইদের রাজার রাজা রিষার্ট জরগে সম্বন্ধে অনেক কিছু পাকা খবর জানা গিয়েছে। অবশ্য এ সত্য প্রতিভাসিত যে, যে কোনও স্পাই সম্বন্ধে সব খবর কোনওদিনই পাওয়া যায় না। স্পাই ধরা পড়ার পর তার সম্বন্ধে সব খবর যদি খুঁড়ে বের করা যায় তবে সে চা পাই।
কিন্তু তার পূর্বে আরেকটি কথা বলে নিই। গুপ্তচরবৃত্তি বা এসপিয়োনাজের প্রথম অলিখিত আইন, গুপ্তচর যদি বিদেশে ধরা পড়ে তবে যেদেশের হয়ে সে কাজ করছিল সেদেশ কিছুতেই স্বীকার করে না যে ওই লোক তাদের গুপ্তচর। তার কারণ, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে এক দেশ অন্য দেশে সরকারিভাবে গুপ্তচর রাখতে পারে না– অথচ আশ্চর্য, প্রায় সব দেশই সেটা করে থাকে।
পৃথিবীর ইতিহাসে জরগে একমাত্র ব্যত্যয়। রুশের হয়ে ইনি জাপানে সুদীর্ঘ দশ বৎসর কৃতিত্বের সঙ্গে স্পাইগিরি করে ১৯৪১-এ ধরা পড়েন এবং ১৯৪৪-এ তার ফাঁসি হয়। যুদ্ধশেষে যখন তার কর্মকীর্তির অনেকখানি প্রকাশ পেল তখন তাবৎ ইয়োরোপে হইচই পড়ে গেল এবং বহু ভাষায় তার সম্বন্ধে বিস্তর সিরিয়াল রগরগে কেতাব, সিনেমা, নাট্য ইত্যাদি তাবৎ পূর্ব-পশ্চিমকে রোমাঞ্চিত করে তুলল। বিশেষ করে জাপানকে। কারণ এইমাত্র বলেছি তার শেষ কর্মভূমি ছিল জাপান।
এবং এই ডামাডোলের মধ্যিখানে কোথায় না রুশ তার গোরস্তানের নৈস্তব্ধ্য বজায় রেখে নিস্তব্ধতা হিরণয়–সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন নীতি পুনরায় সপ্রমাণ করবে, উল্টো পৃথিবীর সব রাজনৈতিক-ঐতিহ্য ধূলিসাৎ করে সগর্বে সদম্ভে সরকারিভাবে স্পাই জরগের স্মৃতির উদ্দেশে বলশেভিক রুশ দেশের সর্বাধিপতি সর্বোচ্চ সম্মান মেডেল ইত্যাদি অর্পণ করলেন– এ মেডেল রুশ দেশের যুদ্ধকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ বীরদেরই দেওয়া হয় মাত্র। যতদূর মনে পড়ছে তার ছবিসহ স্ট্যাম্পও বেরিয়েছিল।(১) কিন্তু হায়, সে মেডেল গ্রহণ করার জন্য জরগের দারাপুত্র পরিবার কেউ ছিল না। তার স্ত্রীকে তিনি বহু পূর্বেই তালাক দিয়েছিলেন– তার গুপ্তচরবৃত্তিতে সম্পূর্ণ একনিষ্ঠ আত্মনিয়োগ করার জন্য। অনেকটা হিটলারের মতো। তিনিও ওই কারণে আদৌ বিয়ে করেননি– করলেন, যখন তার রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চের বৃহৎ কৃষ্ণ যবনিকা নটগুরু মহাকাল কামান গর্জনের অট্ট করতালির মাঝখানে নামিয়ে দিলেন, এবং সে বিবাহ সেই কৃষ্ণ যবনিকার অন্তরালে। আত্মহত্যার পিস্তলধ্বনি সে বিবাহের আতশবাজির বোম। স্ত্রীও নাট্যমঞ্চের জুলিয়েতের মতো বিষপান করলেন।… মার্কিন খবরের কাগজের নেকড়েরা এড়ি (পূর্ব বাঙলার মুসলমানি ভাষায়, তালাকপ্রাপ্তা রমণীকে এড়ি–ডিভোর্সে–এবং বিধবাকে বাড়ি বলে) জরগেকে খুঁজে বের করুল। রমণী স্বল্প- তথা সত্য-ভাষিণী। তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, ন-সিকে খাঁটি স্পাইদের মতো জরগে তার স্ত্রীকে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে দেননি তিনি কী নিয়ে দিবারাত্র লিপ্ত থাকেন।