একইসঙ্গে প্যারিসের তিনখানা প্রখ্যাততম পত্রিকা মারফত শুধু কলাবিভাগের নয়, অসাধারণ জ্ঞাতব্য সংবাদরূপে কাগজের উত্তমাঙ্গেও প্রকাশিত প্যারিসবাসী এবং দু-তিন দিনের ভিতর তাবৎ ফরাসিস জাতি এই নব অরুণোদয়ের সংবাদ পেয়ে বিস্মিত, স্তম্ভিত ও মুগ্ধ হল। ক্রমে ক্রমে সর্ব আর্টজর্নলে, বিশেষ করে সেইসব আলট্রা-মডার্ন-আর্টজলে, যেগুলো খবরটা সর্বপ্রথমে পরিবেশন করতে পারেনি বলে ঈষৎ বিব্রত বোধ করছিল, সর্বত্রই এই নবীন আর্টিস্ট সম্বন্ধে কলামের পর কলাম, পাতার পর পাতা জুড়ে নানাপ্রকারের বিশ্লেষণ তথা তাঁর প্রথম চিত্রের জন্ম থেকে শেষ চিত্র অবধি তার ক্রমবিকাশের সুনিপুণ ইতিহাস সবিস্তার বর্ণিত হল। শেষটায় কিন্তু একে লুফে নিলেন আলট্রা-মডার্ন আর্টের ক্রিটিকদের চাইরাই। এরা অ্যাকাডেমিক আর্টের জন্মশত্র, কসমূ-খাওয়া-খুনি-দুশমন। অন্যপক্ষে প্রথমটায় কিঞ্চিৎ গাইগুই না-রাম-না-গঙ্গা ধরনের দু-একটা মন্তব্য করার পর আলট্রা মডার্নদের হাতে ঘোল খেয়ে চুপসে রঙ্গভূমি বা জঙ্গভূমি, যাই বলুন, পরিত্যাগ করলেন। ওদিকে সেই চিত্রকরের ছবি দেখবার জন্য যা ভিড়, সেটা সামলাতে গিয়ে প্যারিস পুলিশের মতো সহিষ্ণু প্রতিষ্ঠানও হিমশিম খেয়ে গেল। ওঁর ছবি না-দেখা থাকলে তো প্যারিসের শিক (chic) সমাজে মুখ দেখানো যায় না, ওঁর সম্বন্ধে বিজ্ঞভাবে কথা বলাটাই তখন দ্যনিয়ে ক্রি– dernier cri- শব্দে শব্দে অনুবাদ করলে শেষ চিৎকার কিন্তু তার থেকে আসল অর্থ ওত্রায় না, বরঞ্চ আখেরি কালাম বললে ওরই গা ঘেঁষে যায়। আর্টের ব্যাপারে ফরাসি হনুকরণ (to ape)-কারী ইংরেজও ওই দর্নিয়ে ক্রি-ই আপন ভাষাতে ব্যবহার করে, অর্থ uterunost refinement- এরকম দুটো শব্দ কিছুতেই অনুবাদ করা যায় না বলে।
এমন সময় সিন্দবাদের সেই সুদর্শন, নিটোল, নিখুঁত সি-মোরগের আণ্ডাটি গেল ফেটে, কিংবা কেউ দিলে ফাটিয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে বেরুল উৎকট পচা দুর্গন্ধ। প্যারিসে তিষ্ঠনো কি সোজা ব্যাপার।
সেই যে বলেছিলুম একইসঙ্গে প্যারিসের তিনখানা প্রখ্যাততম পত্রিকা মারফত এই নবীন রবির প্রথম সংবাদ বেরোয়, এবং পরে সকলের অলক্ষ্যে এঁরা কেটে পড়েন সেই তিন সংবাদদাতা বা জালিয়াৎ আঙটি ফাটালেন– সর্বজনসমক্ষে ফটোগ্রাফসহ।
আসলে বানরালে নামে কোনও আর্টিস্টই নেই। এই তিন মিত্র একটা গাধাকে শক্ত করে বেঁধে নেন একটা খুঁটিতে। লম্বা ন্যাজে মাখিয়ে দেন সযত্নে, আর্টিস্টরা–বরঞ্চ বলা উচিত আলট্রামডার্ন আর্টিস্টরা যে রঙ, অয়েল কালার ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, সেইসব রঙ। তার ন্যাজের কাছে, পিছনে, আটিস্টদের তেপায়া স্ট্যান্ড বা ইজলের উপর ক্যানভাস। তার পর সেই গাধাটাকে দে, বেধড়ক মার! সে বেচারি পিছনের ঠ্যাং দুটো তুলে যত লাফায়, ততই তার নানা-রঙে-রাঙা ন্যাজ থাবড়া মারে ক্যানভাসের উপর। সঙ্গে সঙ্গে আঁকা হয়ে যায় মোস্ট আলট্রামডার্ন ছবি! ভিন্ন ভিন্ন সাইজের ভিন্ন ভিন্ন ক্যানভাস নিয়ে, গাধার ন্যাজ কখনও বিনুনির মতো ভাগ করে, কখনও গোচ্ছ গোচ্ছা করে বেঁধে যার যথা অভিরুচি–রঙের ভিন্ন ভিন্ন সংমিশ্রণ করে আঁকা হল ছবির পর ছবি! এবং পাছে লোকে অবিশ্বাস করে তাই ছবির প্রতি স্টেজে তার ফটো, গাধার লম্পঝম্পের ফটো, গর্দভের পুচ্ছাংশসহ চিত্রাংশের ফটো– এককথায় শব্দার্ধে ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফ তোলা হয়েছে অপর্যাপ্ত।
তিন জালিয়াত বলা বাহুল্য, এরা তল্কালীন তথাকথিত মডার্ন আর্টিস্টদের গোঠ বেঁধে, দল পাকিয়ে চিৎকার ও অ্যাকাডেমিক আর্টের উদ্দেশে তাদের অশ্রাব্য কটুবাক্য শুনতে শুনতে হন্যে হয়ে গিয়ে শেষটায় উপযুক্ত সত্ত্বারটি করেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে আবার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দিলেন বানরালে নামটার মধ্যখানে ane- ফরাসিতে যার অর্থ গর্দভ শব্দটি গোপনে গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ গাধাটিই এসব ছবির প্রকৃত আর্টিস্ট।
তস্য বিগলিতাৰ্থ, মোস্ট-আলট্রা-মডার্ন-আটিস্ট তথা তাদের মুখপাত্র আর্টক্রিটিকরা আদিন ধরে যাকে তাদের শিরোমণি করে, তাদের হিরো বানিয়ে বিনা বাদ্যে নেচেছেন (কী কল পাতাইছ তুমি! বিনা বাইদ্যে নাচি আমি।- লেখকের মাতৃভূমির প্রবাদ) তিনি একটি গর্দভ!
এ-জাতীয় ঘটনা আরও ঘটেছে। তার ফিরিস্তি দিতে যাবে কে আর উপরের উল্লিখিত ঘটনাটির পিছনে রয়েছে নষ্টামি। কিন্তু যেখানে কোনওপ্রকারের কুমতলব নেই, সেখানেও যে এরকমের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে সেটা বছর পাঁচেক পূর্বে সপ্রমাণ করে সুইডেনের মতো ঠাপ্ত দেশ।
সুইডেনের অন্যতম প্রখ্যাত অতি আধুনিক চিত্রকর কালক্ট্রোম ছবি আঁকার সময় একখানা ম্যাসোনাইটের টুকরোয় মাঝে মাঝে তুলি পুঁছে নিতেন। কাজেই সেটাতে হরেকরকম রঙ লেগে থাকার কথা। ওই সময় সুইডেনের ললিতকলা আকাঁদেমি এক বিরাট মহতী চিত্রপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন–স্বতঃস্ফূর্ত কলা (Spontaneous art বা স্পন্টানিসাস এর নাম এবং এটাকেই তখন সর্বাধুনিক কলাপদ্ধতি বলা হত) ও তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ এই নাম দিয়ে সেই চিত্রপ্রদর্শনীতে থাকবে সুইডেন তথা অন্যান্য দেশের স্পন্টানিসমু কলার উত্তম উত্তম নিদর্শন। তখন হয়েছে কী, চিত্রকর ফালক্ট্রোম তার অন্য ছবি যাতে ডাকে যাবার সময় জখম না হয় সেই উদ্দেশ্যে পূর্বোল্লিখিত তুলি পৌঁছার রঙবেরঙের ম্যাসোনাইটের টুকরোখানা তার অন্য দু-খানা ছবির উপর রেখে প্যাক করে প্রদর্শনীতে পাঠিয়ে দেন– এস্থলে বলা উচিত ফালক্ট্রোম ছবি ক্যানভাসের উপর না এঁকে আঁকতেন ম্যাসোনাইটের উপর। আকাঁদেমির বড়কর্তারা ভাবলেন এটাও মহৎ আর্টিস্টের এক নবীন কলানিদর্শন, এবং পরম শ্রদ্ধাভরে সেই তুলি পোঁছার টুকরোটির নিচে আর্টিস্টের স্বনামধন্য নাম লিখে বুলিয়ে দিলেন তাঁর অন্য ছবির পাশে।