এই ধরুন কিছুদিন আগেকার কথা। এক টাকার-কুমিরের উচ্চাশা হয়েছে তিনি সমাজেও যেন গণ্যমান্য ব্যক্তিরূপে উচ্চাসন লাভ করেন। হঠাৎ একদিন আমার কুটিরের সম্মুখে এসে দাঁড়াল এক বিরাট মোটরগাড়ি। তার দৈর্ঘ্য এমনই যে সেটার ন্যাজামুড়ো করতে হলে হঠাৎ পিছনের লাগেজ কেরিয়ার থেকে সম্মুখের বনেটের নাক অবধি সেখানে পদাধিকারলব্ধ পতাকা পৎ পৎ করে, এর গাড়িতে অবশ্য পতাকা ছিল না যেতে হলে আরেকটা মোটরগাড়ি ভাড়া করতে হয়! তা সে যাই হোক, যাই থাক, যেই যক্ষ (অবশ্য ইনি কালিদাসের একদারনিষ্ঠ বিরহী যক্ষ নন–এর নাকি ভূমিতে আনন্দ; থাক শঙ্করের চৌরঙ্গী পশ্য) এসে এই অধমকে আলিঙ্গন করে একখানা চেয়ারে আসনপিড়ি হয়ে বসলেন।
নিম্নলিখিত রসালাপ হল :
যক্ষ ॥ আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হওয়াতে বড় আনন্দিত হলাম। আমি বহুকাল ধরে আপনার একনিষ্ঠ পাঠক। আপনার অগ্নিবীণা আপনার বিদ্রোহী উপন্যাস আমি পড়েছি, কতবার পড়েছি বলে শেষ করতে পরব না। ওহ। কী করুণ, কী মধুর!
হরি হে, তুমিই সত্য।
আমি ॥ (মনে মনে) সর্বনাশ! ইনি আমাকে কবিবর নজরুল ইসলামের সঙ্গে গোবলেট করে ফেলেছেন! যে ভুল পাঠশালার ছোকরাও যদি করে তবে সে খাবে ইস্কুলের বাদবাকি পড়ুয়াদের কাছে বেধড়ক প্যাদানি। তদুপরি যক্ষবর বলছেন, বিদ্রোহী কবিতাটি নাকি উপন্যাস এবং সেটি নাকি বড়ই করুণ আর মধুর! এস্থলে আমি করি কী! যে ব্যক্তি গাধাকে (এস্থলে আমি) দেবে বলে এটা রেসের ঘোড়া (এস্থলে কাজী কবি কবি-পরিবার যেন অপরাধ না নেন, আমি নিছক রূপকার্থে নিবেদন করছি) সে ব্যক্তি গাধাকে তো চেনেই না, ঘোড়াকেও চেনে না। ইতোমধ্যে পুনরপি,
যক্ষ ॥ (স্মিতহাস্য করে) আপনার বড় ভাই সৈয়দ মুস্তাফা শিরাজ এই যিনি তালতলার খ্যাতনামা পুস্তক প্রকাশক- তিনিও আমার ছোট ভাইয়ের কাছে প্রায়ই আসেন। বড় অমায়িক বৃদ্ধ। শুনেছি আমাদের বাড়ির পাশেই তার বিরাট তেতলা বাড়ি।
হরি হে, তুমিই সত্য! তুমিই সত্য।
আমি ॥ (মনে মনে) এই আমার জীবন সর্বপ্রথম আমার পিরামিড-দৃঢ় হরিভক্তিতে চিড় ধরল। হরি যদি সত্যই হবেন তবে তাঁকে সাক্ষী রেখে এই লোকটা মিথ্যার জাহাজ বোঝাই করে যাচ্ছে আর তিনি টু ফুঁ করছেন না, এটা কী প্রকারে হয়? ওদিকে শিরাজ মিঞা খাঁটি বিদগ্ধ রাঢ়ের ঘটি, আর আমি সিলট্যা খাজা বাঙাল। ওর সঙ্গে আমার কোনও আত্মীয়তা নেই– থাকলে নিশ্চয়ই শ্লাঘা অনুভব করতুম। অবশ্য আমরা সবাই আদমের সন্তান; সে হিসেবে তিনি আমার আত্মীয়। তদুপরি বেচারি পুস্তক প্রকাশক নয়, ঢাউস বাড়িও তার নেই, যদুর জানি আমারই মতো দিন-আনি-দিন-খাই চাকরিতে পুরো-পাক্কা-পার্মানেন্ট। এবং বাচ্চা শিরাজ– যে আমার পুত্রের বয়সী সে নাকি আমার অগ্রজ এবং বৃদ্ধ! বৃদ্ধ! বুঝুন ঠ্যালা। আশা করি এ লেখন বাবাজির গোচর হলে তিনিও সব্যসাচীর ন্যায় আমাকে মাফ করে দেবেন। ইতোমধ্যে পুনরপি,
যক্ষ ॥ (তার দেওয়া বিবিধ-ভারতীর মতো বিবিধ সংবাদ যে আমাকে একদম হতবাক করে দিয়েছে সেইটে উপলব্ধি করে, পরম পরিতোষ সহকারে আচ্ছা, আপনি কি শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া করেছিলেন?
আমি ॥ (মনে মনে, যা মিথ্যের জাহাজ সত্যের চড়াতে এসে কিছুটা ঠেকেছে) আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে বিশেষ ফলোদয় হয়নি সে তো দেখতেই পাচ্ছেন।
– আহা কী যে বলেন! আচ্ছা, আপনার হাতের লেখা নাকি রবিঠাকুরের মতো
— অনুকরণ করেছিলুম। সে সুন্দর লেখার কাছে আমার লেখা কি কনিকালেও পৌঁছতে পারে।
–আচ্ছা, কিন্তু আপনি নাকি হুবহু তাঁর নাম সই করতে পারেন? একবার নাকি তার নাম সই করে ভুয়ো নোটিশ মারফত আশ্রমকে একদিনের ছুটি দেন। পরে নাকি আপনি নিজেই সেটা ফাঁস করে দেন।
আমি কীর্তিটি অস্বীকার করলুম না। কিন্তু যক্ষরাজ কোনদিকে নল চালাচ্ছেন সেঁটে বসে, তখনও বুঝিনি। জানালা-দরজার দিকে ঘুরে এবারে চেয়ার ছেড়ে তক্তপোশে আমার গা সেঁটে বসে, জানালা দরজার দিকে ঘোর সন্দিগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ফিসফিস করে আমার কানে কানে বললেন, বাবু, তোমার হাল তো দেখতে পাচ্ছি। তোমার দু-পয়সা হবে : আমারও ফায়দা হবে। কিন্তু কাককোকিল পোকাপরিন্দায়ও যেন জানতে না পায়।
আমার প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথের একখানা সার্টিফিকেট। আমি যে তার জীবিতাবস্থায় গোপনে গোপনে দেশসেবা, পলিটিক্যাল কাজ এবং বিশ্বভারতাঁকে সাহায্য করছিলাম সেই মর্মে একখানা চিঠি। শেষ বয়েসে তার প্রায় সব চিঠিই ইংরেজিতে টাইপ হতো, তিনি শুধুমাত্র সই করে দিতেন।
আপনাকে কিছুটি করতে হবে না। আমি সেই জরাজীর্ণ টাইপরাইটার মেলা জাঙ্কের সঙ্গে নিলামে কিনেছি, অবশ্যই দালাল মারফত। আমার কপাল ভালো। ওইসব হাবিজাবির ভিতর তাঁর প্রাচীন দিনের একগুচ্ছ লেটারহেড সমেত হলদে ফ্যাকাসে নোটপেপারও পেয়ে গিয়েছি। টাইপরাইটারটা সযতে মেরামত করেছি। এখন এটা ঠিক ১৯৩৮/৩৯/১-এর মতোই ছাপা ফোঁটায়। আমি পাকা লোককে দিয়ে সার্টিফিকেটের মুশাবিদা করাব, টাইপ করাব। তার পর কবির দস্তখতটি হয়ে গেলে দলিলটি রেখে দেব আঁকাড়া চালের বস্তার ভিতর। ব্যস! আর দেখতে হবে না। টাইপের কালি, দস্তখতের কালি সব ম্যাটমেটে মেরে গিয়ে ১৯৪১ সালের চেহারা নিয়ে বেরুবে সেই খানদানি চেহারা নিয়ে।