এর ওপর আরেকটা কথা আছে। অপমান করতে পারে কে, কাকে? আমি গেলুম আপনার বাড়িতে। আপনার চাকর আমাকে খামোখা কতকগুলি কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিল বৈঠকখানায় ঢুকতেই দিল না। এস্থলে সে আমাকে অপমান করেনি, করেছে রূঢ় ব্যবহার আমাকে অপমান করার মতো সামাজিক আসন তার কোথায়? আবার দেখুন, অন্য আরেকদিন আপনার ঠাকুরদা বসেছিলেন বারান্দায়। আমাকে দেখেই খাপ্পা হয়ে আমাকে নাহক বকতে শুরু করলেন। সেস্থলেও আমি অপমানিত নই। কারণ আমি আপনার বন্ধু। আমার পিতামহের বিলক্ষণ হক আছে আমাকে কড়া কথা বলার।… অপমান হয় সমপর্যায়ে। যেমন মনে করুন, সন্তোষ ঘোষ। তিনি লেখক, আমিও লেখক। তিনি আমাকে অপমান করতে পারেন, আমিও তাকে অপমান করতে পারি। আরেকটি নজির দিই। যদ্যপি আইনে বারণ তথাপি ইতালি প্রভৃতি কোনও কোনও দেশে ডুয়েল লড়ার প্রথা প্রচলিত আছে। কিন্তু সেখানেও যদি আপনার ভৃত্য ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে ডুয়েলে চ্যালেন্জ করে, সে খবর জানিয়ে দুজন প্রতি চাকরের প্রতিভূদের সঙ্গে দুমিনিট আলোচনা করেই, একবাক্যে চারজনাই রায় দেবেন, এ ডুয়েল হতে পারে না। দুজনার পদমর্যাদা এক নয়। চাকরটা শুধু তার পদমর্যাদা বাড়াবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেন্ করেছে।
মরক্কো দেশ কোথায়, মশাই? শুনেছি সেখান থেকে মরক্কো লেদার নামক পুরু চামড়া রপ্তানি হয়। পুরু চামড়া নিশ্চয়ই। নইলে সেখানকার লোক এই সুদূর ভারতবর্ষের লোককে নিমন্ত্রণ করে তাদের অর্বাচীন ইতিহাসে (প্রাচীন ইতিহাস এদের নেই) এই বোধহয় তারা কাউকে কখনও নিমন্ত্রণ করল– এরকম পুরু চামড়ার আচরণ করবে কেন? তদুপরি শুনেছি, মরক্কো দেশকে নাকি এখনও বহু বাবতে ফ্রান্স এবং স্পেনের কথামতো চলতে হয়, এবং সর্বশেষে শুনেছি, স্পেন ও ফ্রান্সের ঝগড়ার সুযোগ দিয়েই এদেশের যেটুকু স্বাধীনতা আছে সেটুকু বেঁচেবর্তে আছে। আমার কেমন যেন সন্দেহ জাগে, মুসলিম রাষ্ট্রদের নিমন্ত্রণ করে এরা যেন সেই ইতালির ডুয়েলকামীর মতো পদমর্যাদা বাড়াতে চেয়েছিল। আমার তো মনে হয় না, আ মসজিদের আগুন মরক্কোর বুকে কোনও আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
কোথায় মরক্কো, কোথায় ভারত পদমর্যাদায় কোথায় ভারত আর কোথায় সেই ধেড়ধেড়ে গোবিন্দপুর টা-পেনি হে-পেনি মরক্কো! সে আমাদের ইনসল্ট করবে কী করে?
ফখরুদ্দীন সাহেব, দীনেশবাবু, আমাদের ফরেন আপিস যা করলেন সেটা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। আমার দুঃখ, খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখে চিঠিপত্র ছাপিয়ে এদেশের মুসলমানরা এদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন না কেন? বলেন না কেন যে, এদেরই হয়ে একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত সরকার ওই একটা থার্ড ক্লাস দেশে গিয়েছিল।
যদ্যপি-বা স্বীকার করি– আমি করি না যে ভারত রাবাতে ইনসল্টেড হয়েছে তথাপি বলব, মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অপমানিত হওয়াতে লজ্জার কিছু নেই। ক্ষুদ্র স্বার্থপর উদ্দেশ্য নিয়ে জয়ী হলেও উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করার কিছু নেই।
সিংহ-মূষিক কাহিনী
চল্লিশ বৎসর বয়সের ঘাটের থেকে যৌবনতরী বিদায় দেওয়ার পরও কখনও আশা করতে পারিনি, স্বপ্নেও সে আকাশ-কুসুম চয়ন করতে পারিনি যে এ অধমের জীবদ্দশাতেই স্বরাজ আসবে, স্বাধীন জীবন কাকে বলে তা এই চর্মচোখেই দেখে যেতে পারব।
কিন্তু প্রভু যখন দেন, তিনি তখন চাল-ছাত চৌচির করে ঐশ্বর্য-বৈভব (নিয়াম গণীমৎ) ঢেলে দেন। হঠাৎ একদিন হুড়মুড়িয়ে স্বরাজ এসে উপস্থিত–বন্যার প্লাবনের মতো। ফলে আমরা সবাই যে কহাঁ হাঁ মুল্লুকে ভেসে গেলুম এবং এখনও এমনই যাচ্ছি যে তার দিকচক্রবালও দেখতে পাচ্ছিনে। আমি ইচ্ছে করেই এই অতিশয় প্রাচীন, সাদামাটা তুলনাটি পেশ করলুম, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তুলনা তিন ঠ্যাঙের উপর ভর করে দাঁড়ায়, কিন্তু এস্থলে তুল্য ও তুলনীয় এমনই টায়-টায় মিলে গেছে- স্বরাজ এবং বন্যা, যে এটি সত্যি চার ঠ্যাঙের উপর দাঁড়িয়েছে। তুলনাটি যে কীরকম মোক্ষম ড্রেনপাইপ পাতলুনের মতো টাইটফিট তার আরেকটি নিদর্শন দিই। এই প্রলয়জলধিতে যেসব কর্তাব্যক্তিরা নৌকো ভেলা পেয়ে গেলেন তারা বানে ভেসে-যাওয়া বেওয়ারিশ মাল (দেশের সম্পদ, কোম্পানি কা মাল, যদি বেওয়ারিশ না হয় তবে বেওয়ারিশ আর কারে কয়!) আঁকশি দিয়ে ধরে ধরে আপনআপন ভল্টে বোঝাই করলেন। এখানে আরও একটা মিল রয়েছে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, গুটিকয়েক অ্যাভূরি ইয়ং টার্ক-এর অবিমৃষ্যকারিতার ফলে ব্যাঙ্ক ভল্ট বাবদে এমনসব ব্যবস্থা নেওয়া হল যে সেগুলো সেই বানের জলে উৎক্ষিপ্ত প্রক্ষিপ্ত হয়ে ভেসে ভেসে চলেছে। কোন কূলে ভিড়বে– আমরা তো অনুমান করতে পারছিনে। তবে মাভৈঃ! এসব ঘড়েল কুমিরগুষ্টি যখন জলের অতল থেকে নির্বিচারে অবলা কুমারী থেকে গোবর-গামার ঠ্যাং কামড়ে ধরে বদান্ন ভক্ষণ করতে পারেন, তখন এইসব বেওয়ারিশ প্রাণহীন তল্ট কামড়ে ধরে সেগুলোকে নদীর অর্ধনিমজ্জিত গহ্বরে নিয়ে যাওয়া তো এদের কাছে শনির অপরাহ্নের পিকনিকের মতো নির্দোষ সহজ সরল, কিংবা বলতে পারেন অত্যাবশ্যকীয় রাজকার্যের অনুরোধ হাওয়াই দ্বীপে বসন্তযাপন অথবা শীতে মন্তে কার্লো ভ্রমণ।
সন্দেহপিচেশ পাঠক হয়তো ভাবছ, আমি নিজে সেই হালুয়ার কোনও হিস্যে পাইনি বলে বন্ধ্যা রমণীর ন্যায় শতপুত্রবতীদের অভিসম্পাত দিচ্ছি। মোটেই না। আমার কপালেও ছিটেফোঁটা জুটেছে! ইরানের প্রখ্যাত কবি মৌলানা শেখ সাদি বলেছেন, ইহ-সংসারে মহাজন ব্যক্তি মাত্রই (সাদি গুণীজ্ঞানী অর্থে বলেছেন এস্থলে কিন্তু আপনাকে যখ সম্প্রদায়ের বেনেদের কথা ভাবতে হবে যেন আতরের ব্যবসা করেন। তোমাকে মিন-পয়সায় আতর না দিলেও তাবৎ আতরের বাক্সে ডবল তালা মেরে বন্ধ রাখলেও বাড়িময় যে আতরের খুশবাই ম-ম করছে এবং তোমার নাসিকা-রন্ধ্রে প্রবেশ করছে, সেটা ঠেকাবেন কী প্রকারে? এস্থলে তাই। এ মহাজনরা যদ্যপি বাইশ বৎসর ধনদৌলত ব্রা গোটা আষ্টেক লোহার সিন্দুকের উপর ডবল ডানলোপিলোতে বিচ্ছি যামিনী যাপন করেছেন তথাপি এগুলো বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে এদের খুলতে হয় তখন পাকা বেল ফেটে গিয়ে যে কাককুল প্রবাদানুযায়ী এ রস থেকে বঞ্চিত তারাও তার হিস্যে পেয়ে যায়।