কিন্তু দীনেন্দ্রকুমার বরোদায় খুব বেশিকাল থাকেননি।
কারণ ইতোমধ্যে বরোদার মহারাজা, শ্রীঅরবিন্দ, অন্যতম বরোদাপ্রধান খাসে রাও যাদব এবং (বোধহয়) দেশপাল্পে মধ্যে কী-সব গুপ্ত মন্ত্রণা হয়, সে সম্বন্ধে আমি সঠিক জানিনে। ফলে শ্রীঅরবিন্দ বরোদা ত্যাগ করে কলকাতায় এসে বিপ্লবী আন্দোলন আরম্ভ করেন। কিন্তু এ ভিন্ন কাহিনী।
দীনেন্দ্রকুমার বাঙলায় ফিরে এলেন।
এর পর তাঁর জীবন-কাহিনী আমার কাছে আরও অস্পষ্ট।
তবে আমার মনে সন্দেহ হয়, একালেও যখন বাঙালি সাহিত্যস্রষ্টা শুধুমাত্র সাহিত্য সৃষ্টি করে দ-উদর-জ্বালা শান্ত করতে পারে না(২), তা হলে ভদ্রলোক বোধহয় খুবই অর্থকষ্টে ছিলেন। তখন ১৯১৫, এরকম সময় দীনেন্দ্রকুমার গত্যন্তর না দেখে ডিটেক্টিভ স্টোরি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করতে আরম্ভ করলেন। তারই নাম রহস্য লহরি। সঠিক অনুবাদ বললে বোধহয় একটু ভুল হয়। যেখানেই সুযোগ পেতেন, সেখানেই কিঞ্চিৎ বঙ্গোপযোগী বাঙালি ধরনধারণ ঢুকিয়ে দিতেন।
এই রহস্য লহরি এদেশে তখন যে উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল, তার বয়ান আজ দেবে কে সাধুবাদসহ বলি, নোটবুক তার যথাসাধ্য চেষ্টা দিয়েছেন।
কিন্তু এই উন্মাদনার প্রধান কারণ কী?
আমি দৃঢ়প্রত্যয়, সত্যনিশ্চয় যে-ভাষাতে দীনেন্দ্রকুমার তার রহস্য লহরি লিখলেন, ওরকম ঝরঝরে, ছিমছাম সরল স্বচ্ছ শীতের নদীস্রোতের মতো শান্ত প্রবহমান বাংলা ভাষা এই দেড়শো বছরের ভিতর অতি অল্প লোকই লিখেছেন।
তা না হলে বলুন তো, বারো বছরের বাঙাল বালক তার সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা বিলাতের গল্প পড়ে অর্ধমিনী অবধি বিদ্রি অবস্থায় শিহরিত, কস্পিত, রোমাঞ্চিত হয়ে রইল কেন?
ভাষা, ভাষা, ভাষা! ভাষা বহু তিলিসমাং বহু মিরাকল, বহু অলৌকিক কর্ম করতে পারে।
———–
১. বরোদাতে বাঙালি নাম দিয়ে একটি গ্রন্থ লেখা যায়। ঔপন্যাসিক বেদজ্ঞ সুপণ্ডিত রমেশচন্দ্র দত্ত, শ্রীঅরবিন্দ থেকে আরম্ভ করে সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথের নাতি সুপ্রকাশ গাঙ্গুলী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পুত্র বিনয়তোষ ভট্টাচার্য এবং আরও উত্তম উত্তম বাঙালিকে বরোদার মহারাজা সয়াজি রাও কর্ম দেন।… এস্থলে একটি ব্যক্তিগত নিবেদন আমার আছে। আমার প্রতি দরদী পাঠক ভিন্ন অন্যেরা যেন বাকিটুকু না পড়েন। ১৯৩৪-এ আমি যখন কাইরোতে শাস্ত্র অধ্যয়ন করছি তখন ওই সয়াজি রাও আমাকে পাকডুকে বরোদায় নিয়ে এসে একটি অত্যুত্তম কর্ম দেন। মহারাজা একদিন আমাকে রমেশচন্দ্র দত্ত, শ্রীঅরবিন্দের অনেক কাহিনী বলার পর আমি দুঃখ করে বলেছিলুম- Your Highness! I am your latest and worst choice.মহারাজ তখন গুন গুন করে সেকালের একটি song-hit a you are not my fist love, but you could be my last love!… কিছুদিন পরেই মহারাজ গত হন। এ বাবদে শেষ কথা, এই সর্বগুণে গুণী মহারাজ ভারতের নানা জাতের ভিতর সবচেয়ে ভালোবাসতেন বাঙালিকে।
২. নবীনরা হয়তো জানেন না এ বিষয়ে ইতোপূর্বে কী কী মনোবেদনা বাংলা এবং সংস্কৃতে প্রকাশিত হয়েছিল। অর্থকষ্টে যখন মাইকেল মারা যান তখন হেমচন্দ্ৰ লেখেন :
হায় মা ভারতী,
চিরদিন তোর কেন এ কুখ্যাতি ভবে,
যে জন সেবিবে ও-রাঙা চরণ সেই সে দরিদ্র হবে।
এবং বিদ্যাসাগর মশাই সংস্কৃতে বলেছেন,
অস্য দগ্ধেদরস্যার্থে কিং কিং ন ক্রিয়তে ময়া।
বানরীমিব বাগৃদেবীং নর্তয়ামি গৃহে গৃহে।
অধমের তার অক্ষম অনুবাদ :
ওরে পোড়া পেট, কত না কিছুই করি আমি তোর তরে।
বাঁদরীর মতো সরস্বতীরে নাচাচ্ছি ঘরে ঘরে।
রাবাৎ-ইনসল্ট
প্রখ্যাত লেখক রেমার্ক-এর উপন্যাস পশ্চিম রণাঙ্গন নিপ (অল কোআএট)-এর এক জায়গায় আলোচনা হচ্ছে কয়েকজন নিতান্তু সাধারণ সেপাইয়ের মধ্যে। ক্ষীণ স্মৃতিশক্তি ওপর নির্ভর করে প্রতিবেদন নিবেদন করছি। একজন সেপাই শুধোলে, লড়াই লাগে কেন? আরেকজন বলল, দূর বোকা! এক দেশ আরেক দেশকে অপমান করে। তখন লাগে লড়াই। প্রথম সেপাই তখন বলল, কিন্তু আমি তো মোটেই অপমানিত বোধ করছিনে। যারা করছে তারা প্রাণভরে লড়ুক। আমাকে আমার বাড়ি, ক্ষেতখামারে ফিরে যেতে দেয় না কেন?
রাবাৎ সম্মেলনে নাকি ভারতবর্ষ ইন্সন্টেড হয়েছেন। কই, আমি তো মোটেই অপমানিত বোধ করছিনে। তদুপরি আরেকটি তত্ত্ব এস্থলে আমার স্মরণে আসে। আমার বাল্যবয়সে আমার এক গুরুজনের সামনে বাইরের এক ব্যক্তি আমাকে অযথা কড়া কড়া কথা শোনায়। আমি তখন চটে গিয়ে বলি, আমাকে অপমান করছেন কেন? সে ব্যক্তি কোনও উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। আমার সেই মুরুব্বি তখন বলেন, এই তো করলে ব্যাকরণে– পোতোকলে– ভুল। তুমি স্বীকার করে নিলে তুমি অপমানিত হয়েছ। তার পর যে অপমান করেছে সে মাফ না চেয়ে চলে গেল। তুমি রয়ে গেলে অপমানিত। সুতরাং কখনও নিজের মুখে মেনে নিতে নেই, আমি অপমানিত হয়েছি। নিতান্তই যদি তখন তোমাকে কিছু বলতে হয়, তবে বলবে, আপনি এরকম অভদ্র আচরণ করছেন কেন? দোষটা চাপাবে তার ঘাড়ে। এবং আরও নিতান্তই যদি অপমান বোধ করে থাক তবে সেটা জোর গলায় স্বীকার না করে, চুপসে সেটা হজম করে নেবে এবং তক্কে তক্কে থাকবে কখন ব্যাটার ওপর মোক্ষম দাদ তুলতে পারবে-যদ্যপি আল্লাতালার আদেশ সবু (সহিষ্ণুতাসহ ক্ষমা– যার থেকে বাংলার সবুর কথাটা এসেছে। রাবাতের ব্যাপারটা আগাপাশতলা মুসলমানি ছিল বলে মুসলমানি শাস্ত্রের নজির দিলুম।