তাই মাভৈঃ!
———-
১, বিদ্রোহী আমি কথার কথারূপে বলছি না। বস্তুত বাঙালি যে বিদ্রোহী তার ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। (ক) দোয়াবের ব্রাহ্মণ্যধর্ম তাকে অভিভূত করতে পারেনি, ফলে সে সংস্কৃত উচ্চারণ গ্রহণ করেনি, (খ) বৌদ্ধ-জৈনের নিরামিষ সে গ্রহণ করেনি, (গ) মুসলমান আমলে বাঙলা দেশেই সবচেয়ে বেশি লড়াই দিয়েছে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ইত্যাদি বিস্তর বিষয়বস্তু নিয়ে সে ইতিহাস লিখতে হবে।
রহস্য লহরি
২২ সেপ্টেম্বরের হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড কাগজের ক্যালকাটা নোটবুক-এ দীনেন্দ্র কুমার রায় সম্বন্ধে ওই নোটবুকের বিদগ্ধ লেখকের করুণ-মধুর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ অনুচ্ছেদটি পড়ে আমি সত্যই ঈষৎ লজ্জায় মাথা নিচু করলুম। ঈষৎ বললুম এই কারণে যে, আমিও স্থির করেছিলাম যে আগস্ট-সেপ্টেম্বর (দীনেন্দ্রকুমারের জন্ম ২০ আগস্ট ১৮৬৯) তার জন্মশতবার্ষিকীতে আমিও তার স্মৃতির উদ্দেশে আমার নগণ্য শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করব। তার পর বার্ধক্যে যা হয়, বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের জন্মদিন যখন সে ভুলে যায় তখন তরুণ অকরুণ পাঠক তার ক্ষীণ স্মৃতিশক্তির দিকে কটাক্ষ করে তাকে বিড়ম্বিত করবেন না এই তার ক্ষীণতর আশা।
তরুণ পাঠক যদি ২২ সেপ্টেম্বরের ওই হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডটি জোগাড় করতে পারেন তবে তিনি যেন সেই অনুচ্ছেদটি বাংলায় অনুবাদ করে তার ঠাকুর-দিদিমাকে শোনান। আমি কথা দিচ্ছি, তাদের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠবে, ক্ষণতরে তারা আবার কিশোর হয়ে যাবেন, দু-ফোঁটা চোখের জলও ফেলতে পারেন। কারণ পুনরায় বলছি, অনুচ্ছেদটি এ লেখকের চৌদ্দ আনা লেখাতে যা হয় তাই হয়েছে–বড়ই সুন্দর হয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে তাড়াতাড়ি যোগ করছি, আমি লেখক হিসেবে ওঁকে দন্তপূর্ণ সার্টিফিকেট দিচ্ছিনে সামান্য পাঠক হিসেবে আমার দিলরা তারিফ জানাচ্ছি। সে হক সকল পাঠকেরই আছে। আর লেখক হিসেবে বললেই-বা কী? কাগে কাগের মাংস খায় না, এ প্রবাদ জানি। কিন্তু কাগে কাগের মাংস প্রশংসা করে না একথা কখনও শুনিনি।
গুরুজনদের মুখে যা শুনেছি। (বিশেষত মমগ্রজের বাচনিক। কারণ তিনি কুষ্টিয়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন) সেসব তত্ত্ব ক্ষীণ স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে বলেছি। ভুল হয়ে যেতে পারে।
দীনেন্দ্রকুমার রায়ের জন্ম কুষ্টিয়ার কাছেই। সেই জায়গাতেই বা তার অতিশয় কাছে জন নেন বা বিরাজ করেন, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্র, সাহিত্যিক জলধর সেন (যাকে শরশ্চন্দ্র বড়দা বলে সম্বোধন করে সম্মান দেখাতেন এবং এ যুগের প্রথম মুসলমান লেখক মুশরফ হোসেন। তাঁর বিখ্যাত পুস্তক বিষাদসিন্ধু এখনও মুসলমানদের– এবং অনেক হিন্দুদের কাছে সুপরিচিত।
তদুপরি ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। এঁর শ্যামাসঙ্গীত আমি শুনি বাল্যবয়সে, পদকীর্তন শোনার সময়ে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার বহু পূর্বে। হায়, সে গানের কথাগুলো আমার ঠিক ঠিক মনে নেই। তার বক্তব্য ছিল, কাঙাল (অর্থাৎ হরিনাথ) যদি ছেলের মতো ছেলে ইত তবে তুমি জানতে। কাঙাল জোর করে কোল কেড়ে নিত, তুমি পারতে না মা ছাড়তে। গ্রামোফোন কোম্পানির সে রেকর্ড বোধহয় এখন আর নেই।
এবং এই অঞ্চলেরই মহাত্মা লালন ফকির। তাঁর পরিচয় দেবার মতো প্রগলভতা আমার নেই।
.
.
ওই সময়ে গোপনে গোপনে কেমন যেন একটা দ্বন্দ্ব ছিল নদীয়া জেলায় এবং কলকাতাতে। নদীয়ার লোক তো বলতই, এখনও বলে, তাদের বাংলাভাষা সবচেয়ে শুদ্ধ ও মধুর। ওদিকে রাঢ়ের ঈশ্বরচন্দ্র-বঙ্কিম প্রভৃতি তখন কলকাতাকে কেন্দ্র করে, তারা যে ভাষা জানেন, বলেন, সেই ভাষাকেই বাংলা সাহিত্যের বাহনরূপে প্রবর্তিত করেছেন। তাই এখনও নদীয়া তথা পূর্ববঙ্গের বহু গুণী খেদ করেন যে, মীর মু ফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু যখন প্রকাশিত হল, তখন বঙ্কিমচন্দ্র তার বঙ্গদর্শনে পুস্তকটির পরিপূর্ণ সম্মান দেখাননি।
ওই সময়ে, অর্থাৎ গত শতাব্দীর শেষের দিকে, এ শতাব্দীর গোড়াতে দীনেন্দ্র কুমার তার সামান্য কয়েকটি পল্লিচিত্র (নোটবুকের ভাষায় he wrote sketches of village life in a reminicent mood… Generally he starts with a festival and goes on to describe its impact on the different sections of the village population. His pleasant vignettes-পল্লিচিত্রের জন্যে এই ভিনেং শব্দটি একদম mot juste-born out of acute personal observation, present a microscopic picture of life.) ভারতী পত্রিকাকে পাঠান। তখন সম্পাদিকা ছিলেন খুব সম্ভব সরলা দেবী কিংবা তার মাতা স্বর্ণকুমারী দেবী। এই ভিন্নগুলো সম্পাদিকা সানন্দে লুফে নেন এবং বহু বহু গুণী এগুলোর সর্বোত্তম প্রশংসা করেন। এ যেন হঠাৎ একঝলক গাঁয়ের মিঠে মেঠো হাওয়া নগরে ঢুকে শহরের নিরুদ্ধ-নিম্বাস বাতাসকে মোলায়েম করে দিল। এই চিত্রগুলো ওই সময়ে পুস্তকাকারে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
এর পরের ইতিহাস আমি সঠিক কালানুক্রমিক বলতে পারব না। যতদূর মনে আছে তাই নিবেদন করি।
ওই সময়ে শ্রীঅরবিন্দ বরোদার চাকরি নিয়ে বাঙলা দেশে লিখে পাঠান, তাকে বাংলা শেখাবার জন্য যেন একজন উপযুক্ত শিক্ষক পাঠানো হয়। শেষ পর্যন্ত যে দীনেন্দ্রকুমারকেই পাঠানো হয় এর থেকেই আজকের দিনের পাঠক বুঝে যাবেন, সেদিন বাংলা সাহিত্যে তার আসন কতখানি উচ্চ ছিল। এবং হয়তো যাঁরা তাঁকে মনোনীত করেন তারা চেয়েছিলেন শ্রীঅরবিন্দের উচ্চারণটিও যেন খাঁটি নদের মিষ্টি উচ্চারণ হয়।(১)