কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অকালমৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ গভীর শোক প্রকাশ করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যজীবনে যখন এক নবীন ভুবনে প্রবেশ করেছিলেন তখন তার মৃত্যু হয়। আব্দুল হাই যখন জ্ঞানান্বেষণে এক নতুন জগতের সম্মুখীন তখন তার মৃত্যু হল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের গুরু। আজ শুধু আব্দুল হাইয়ের শুরুই তার সম্বন্ধে সার্থক সর্বাঙ্গসুন্দর প্রশস্তি রচনা করতে পারবেন।
তাঁর শিষ্যসম্প্রদায়, আমি, আমরা শুধু আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করতে পারি।
আব্দুল হাইয়ের চরিত্রের একটিমাত্র বৈশিষ্ট্য আমি এস্থলে নিবেদন করি। তার সঙ্গে পাণ্ডিত্যের বিশেষ কোনও সম্পর্ক নেই বলে হয়তো আব্দুল হাইয়ের চরিত্রের এ মহান্ দিকটা অধিকাংশের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। অতি সংক্ষেপে নিবেদন করি।
এ বঙ্গে আমাদের চেয়েও বেশি যদি আজ কেউ প্রিয়বিয়োগ-কাতর হয়ে থাকেন তবে তিনি যদিও আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, তবু তার অবস্থার কিছুটা অনুমান করতে পারি– ডক্টর হরেন্দ্রচন্দ্র পাল, এম-এ (ট্রিপল) ডি-লিট (ক্যাল), রিপন, হুগলি মহসিন, কৃষ্ণনগর কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যাপক। তিনি পূর্ববঙ্গের লোক, কিন্তু বহুকাল ধরে এদেশবাসী।
অধুনা তার একখানি অভিধান বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ– ডক্টর আব্দুল হাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশ করেন। পূর্বতন পঞ্চতন্ত্র-এ আমি এ-গ্রন্থের উল্লেখ করেছি। কিন্তু আমার কথা থাক। এ অভিধান প্রকাশ করার সময় আব্দুল হাই একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা লেখেন। তার থেকে আমি কয়েকটি ছত্র তুলে দিচ্ছি।
হাই সাহেব ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে লিখছেন : কয়েক বছর পূর্বে ডক্টর সুকুমার সেন সাহিত্য পত্রিকায় (এ পত্রিকাটি অধ্যক্ষ আব্দুল হাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমৃত্যু সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন) প্রকাশের জন্য ডক্টর হরেন্দ্রচন্দ্র পালের বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ সঙ্কলন নামে একটি প্রবন্ধ আমাকে পাঠিয়ে দেন। ডক্টর পালের এ প্রবন্ধটি আমি ১৯৬৮ সালের শীত সংখ্যা সাহিত্য পত্রিকায় সানন্দে প্রকাশ করি এবং যতদূর সম্ভব বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে অভিধান আকারে এ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য তাকে অনুরোধ জানাই।
ডক্টর পাল পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী। তাঁর শিক্ষাদীক্ষা পূর্ব পাকিস্তানে। এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানে তার কর্মক্ষেত্র হওয়া উচিত ছিল কিন্তু অদৃষ্টচক্রে তিনি সীমান্তপারে বসবাস করছেন।(৩) তা হলেও তিনি মুসলিম জীবন ও সংস্কৃতিমূলক সাধনাতেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মধ্যযুগ থেকে এ কাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার দেখিয়ে এ বিরাট সংকলন গ্রন্থটি প্রণয়ন করে ডক্টর পাল বাংলা-ভাষী সকলকে এবং বিশেষভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পক্ষ থেকে প্রথমে সাহিত্য পত্রিকায় ও পরে পুস্তকাকারে তার এ মূল্যবান গবেষণামূলক সংকলন গ্রন্থটি প্রকাশ করে বাঙালি সুধী সমাজের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি আজ সত্যিই আনন্দিত।
মুহম্মদ আব্দুল হাই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগ
আমি শুধু এইটুকুই নিবেদন করতে পেরেছিলুম, পণ্ডিত আব্দুল হাই নিজে, তত জ্ঞানচর্চা করেছেনই, কিন্তু তার চেয়েও ঢের ঢের বেশি উৎসাহ দিয়েছেন অন্যজনকে শুধু পূর্ববঙ্গে নয়, এ বঙ্গেও।
আর, আজ যেসব যুবক জ্ঞানচর্চা গবেষণা করতে গিয়ে নানাবিধ অন্যায় অসত্য, মনুষ্যকৃত স্বার্থপ্রণোদিত নীচ-হীন প্রতিবন্ধকের সম্মুখে পদে পদে বিড়ম্বিত হচ্ছে তারা অন্তত এই ব্যত্যয়টি, উৎসাহদাতা আব্দুল হাইয়ের এই চরিত্রমূল্যটি মজ্জায় মজ্জায় অনুভব করবে। আমেন।
———–
১. জলপানি বললুম না, তার অর্থ ভিন্ন। বস্তুত আমি পানি শব্দের দুশমন নই। অতি অবশ্যই আমি জল-পাঁড়ে নামক কাল্পনিক সমাস ব্যবহার করব না। পক্ষান্তরে জজমের জল না বলে জমজমের পানি বলাই ভালো। গঙ্গা পানি কানে খারাপ শোনায়। কিন্তু সেও না হয় সয়ে নিলুম। মুশকিল হবে জলপানি নিয়ে। কেউ জলপানি পেলে সে কি পানি-পানি পায়? যদিও সে খুশিতে পানি পানি হতে পারে, তার জান ত-নৃ– হতে পারে।
২. তবে ইনি এখনও সম্পূর্ণ অচল নন। এবং তাঁর গুণগ্রাহী তথা শিষ্যজনকে সানন্দে জানাই তার তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছেন একটি তরুণ ডাক্তার চট্টগ্রামের চিরঞ্জীব বড়ুয়া। মানুষ বুঝি পিতাকেও অতখানি সেবা করে না।
৩. আব্দুল হাই মুর্শিদাবাদের লোক। অদৃষ্টচক্রে তাকেও সীমান্তপারে বসবাস করতে হল। তাই সমদুখীজনব্যথিতবেদন অনুভব করার মতো অভিজ্ঞতা ও স্পর্শকাতরতা ছিল। তার আপন দুঃখ তিনি ডক্টর পালের মারফত প্রকাশ করেছেন।
মাভৈঃ
বাঙালি সবদিক দিয়েই পিছিয়ে যাচ্ছে, এরকম একটা কথা প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। কথাটা ঠিক কি না, হলপ খেয়ে বলা কঠিন, কারণ দেশ-বিভাগের ফলে তার যে খানিকটে শক্তিক্ষয় হয়েছে সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না। পার্লামেন্টে যদি আপনার সদস্যসংখ্যা কমে যায় তবে সবকিছুই কাটতে হয় ধার দিয়ে ভার দিয়ে কাটার সুযোগ আর মোটেই জোটে না।
দিল্লিতে থাকাকালীন আমি একটি বিষয় নিয়ে কিঞ্চিৎ চিন্তা করেছিলুম। কেন্দ্রে অর্থাৎ ইউপিএসসি-তে বাঙালি যথেষ্ট চাকরি পাচ্ছে কি না? ওই অনুষ্ঠানের সদস্য না হয়েও যারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের বিশ্বাস, বাঙালির এতে যতখানি কৃতকার্য হওয়া উচিত ততখানি সে হচ্ছে না। একদা বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাকেও সেখানে ডাকা হয়েছিল; আমি তখন চোখকান খোলা এবং খাড়া রেখে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করেছিলুম।