উপস্থিত আমার কথা ভুলে যান। সার্থক সাহিত্যিকদের কথাই বলব।
তার কল্পনারাজ্যে বিচরণ করে যুবক-যুবতীর মধ্যে বিরহ ঘটান, বিধবার একমাত্র শিশুপুত্রের মৃত্যু ঘটান এবং এগুলোর চেয়েও নিদারুণতর ট্র্যাজেডি নির্মাণ করেন। তার পর অতিশয় সহানুভূতিপূর্ণ স্পর্শকাতর হৃদয় দিয়ে বিরহকাতরা যুবতাঁকে, পুত্রহীনা বিধবাকে কখনও যুক্তি, কখনও অনুভূতির মারফতে সান্ত্বনা জানান।
এসব কল্পনারাজ্যের কথা।
কিন্তু যখন সার্ধক সাহিত্যিকের আপন জীবনে নিদারুণ শোক আসে তখন তিনি কী করেন। তখন তার অবস্থা হয় সত্যই শোচনীয়। একটি সামান্য দৃষ্টান্ত দিই। আমার চেয়ে অন্তত কুড়ি বছরের বড় জনৈক যশস্বী লেখক একদিন ঢুকলেন আমার ঘরে কাঁদতে কাঁদতে। আমি কোনওকিছু বলার পূর্বেই তিনি বললেন, ভাই আমার ছোট মেয়ে মাধবী কাল বিধবা হয়েছে। লক্ষ্ণৌ থেকে টেলিগ্রাম এসেছে। তুমি ভাই, আমার হয়ে একটা চিঠি লিখে দাও। আমি কী লিখব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি নে।
সেইদিনই আমি প্রথম বুঝতে পারলুম, ব্যক্তিগত বেদনায় সাহিত্যিক কী নিদারুণ অসহায়। অপরের বেদনা সে দূর থেকে দেখে কিছুদিন ধরে সেটাকে মনের ভিতর থিতোয় এবং বেশ কিছুদিন পর সেটাকে সাহিত্যরূপে প্রকাশ করে। কিন্তু নিজের বেলায় হায়, সে অসহায়। এবং সাধারণ অসাহিত্যিক জনের চেয়েও সে নিরুপায়। সাধারণ
অসাহিত্যিক-জন তখন বিধবা কন্যাকে সাদামাটা চিঠি লিখে সান্ত্বনা জানায়। মেয়েও সে চিঠি বুকে চেপে কাঁদে, সান্ত্বনা পায়।
কিন্তু সার্থক সাহিত্যিক? সে তো অনেক বেশি স্পর্শকাতর। এরকম সাদামাটা চিঠি সে তো লিখতে পারে না। তার তো সে অভ্যাস নেই।
সার্থক যশস্বী সাহিত্য-নির্মাতার যদি এই বিপাক হয়, তবে আমার মতো অতিশয় সাধারণ লেখকের কথা চিন্তা করুন।
আমি যে কী মতিচ্ছন্ন সেটি রচনারম্ভেই নিবেদন করেছি।
ভোরবেলা আমার এক চেলা ঘরে ঢুকল, আনন্দবাজার হাতে নিয়ে প্রায়ই আসে। আপন মনে খবরের কাগজ পড়ে।
আজ শুধোল, আপনি তো বাঙাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ এবং পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনের জোর লড়নেওলা অধ্যাপক আব্দুল হাইকে আপনি চিনতেন?
আমি বললুম, চিনতুম মানে? এখনও চিনি। আমার চেয়ে বছর পনরো ছোট। তা হলে কী হয়! লোকটা অসাধারণ পণ্ডিত, এবং সঙ্গে সঙ্গে তার সাহিত্যরসে কী সুন্দর স্পর্শকাতরতা। তদুপরি, তুমি যা বললে, ভাষা আন্দোলনে জোর লড়নেওলা, আমার বন্ধু–
চেলা আমাকে আনন্দবাজার এগিয়ে দিল। তাতে দেখি আব্দুল হাইয়ের ছবি এবং নিচে লেখা :
ঢাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে ডক্টর হাই-এর মৃত্যু।
ভাষা ও ধ্বনিবিদ বলতে শেষ পর্যন্ত বিধাতার কৃপায় বেঁচে রইলেন পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও মৌলানা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এরা উভয়েই পশ্চিম বাংলার কৃতী সন্তান।
দেশবিভাগের ফলে একজন রইলেন কলকাতায়, অন্যজন ঢাকায়। যেন গঙ্গার একভাগ জল এল ভাগীরথী দিয়ে, অন্য হিস্যার পানি চলে গেল পদ্ম দিয়ে পাকিস্তান। তার পর এই বাইশ বৎসর ধরে বিস্তর পানি জল(১) দুধারা দিয়ে বয়ে গেল।
ইতোমধ্যে শ্ৰীযুত চাটুয্যের ওপর নানাবিধ দায়িত্বপূর্ণ কাজের চাপ পড়ল। বয়সও হয়েছে। কাজেই তার প্রাণে যে কামনা ভাষাতত্ত্বের চর্চা– তার জন্য হাতে সময় থাকে অল্পই। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে শুনেছি, শব্দতত্ত্বে জ্ঞানার্থীজনকে তিনি সদাসর্বদা পথনির্দেশ করে দেন। ভরতনাট্যেও বলে, একটা বিশেষ বয়সের পর তুমি আর নৃত্যগীত করবে না, তোমার শিষ্যশিষ্যাদের দেহ দিয়ে তোমার নৃত্যকলা দেখাবে।
ওদিকে, ওপারে ঘটল আরও মর্মন্তুদ ঘটনা। মৌলানা শহীদুল্লাহ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বৎসর দুই পূর্বে আচম্বিতে শয্যা নিলেন(২)– বহু কাজ অসম্পূর্ণ রেখে। গত বৎসর যখন তাকে ঢাকা হাসপাতালে সেলাম দিতে যাই তখন তিনি আমাকে চিনতে পারলেন, অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে– যদ্যপি আমাদের পরিচয় গত অর্ধ শতাব্দী ধরে।
উভয় বাংলাতে আমরা সকলেই আশা করেছিলুম, আব্দুল হাই একদিন শহীদুল্লাহর আসন গ্রহণ করবেন। আমি কোনও সরকারি, বেসরকারি উচ্চপদের কথা ভাবছি না। আমার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল একদিন তার গবেষণা আরও বিস্তৃত সুপরিচিত হবে, তার পথনির্দেশ গৌড়জনকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে।
কিস্মৎ কিস্মৎ –সবই কিস্মৎ! একটি সামান্য উদাহরণ দি :
হাই শব্দের অর্থ জীবন্ত প্রাণবন্ত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জাগ্রত ভগবান। আব্দুল হাই শব্দদ্বয়ের অর্থ ভাই জাগ্রত (জীবন্ত) ভগবানের (অনুগত) দাস।
যিনি তার নামকরণ করেছিলেন তিনি নিশ্চয়ই আশা পোষণ করেছিলেন এ শিশু যেন অতি, অতিশয় দীর্ঘজীবী হয়।
সে চলে গেল পঞ্চাশে। যারা তাকে চিনতেন না, তারা হয়তো ভাবলেন, পঞ্চাশ তো খুব অল্প বয়স নয়। কিন্তু আমার মতো তাকে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ-পরিচয়ে সোনার সৌভাগ্য যাদেরই হয়েছিল তারাই শুধু জানেন পঞ্চাশেও এই লোকটি ছিলেন কী অসাধারণ প্রাণবন্ত (হাই,) বিদ্যাচর্চা রসগ্রহণে সদাজাগ্রত এমনকি মূর্তমান চাঞ্চল্য বললেও অত্যুক্তি হয় না– অবশ্য সদর্থে। এরা সকলেই একবাক্যে বলবেন, আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুর মতো অকালমৃত্যু– এ শোক বিধাতা যেন দয়া করে আমাদের অত্যধিক না দেন।