এই ডাইরিখানার বৈশিষ্ট্য কী?
যুদ্ধশেষে মোটামুটি ১৯৪৯ সালে ডাইরিখানা ডাচ ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে বইখানি জমনে অনূদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইয়োরোপ-আমেরিকাতে প্রচুরতম খ্যাতিলাত করে। কয়েক বছরের ভিতরই বইখানা নূনাধিক ত্রিশ-চল্লিশটি ভাষায় অনূদিত হয়। অনবদ্য বাংলা অনুবাদ করেছেন শ্রীঅরুণ সরকার ও শ্রীঅংকুমার চট্টোপাধ্যায়।
ইতোমধ্যে ডাইরিটি অবলম্বন করে যে নাটকটি রচিত হয়– সেই জর্মন বিশ্বকোষের ভাষায় বিশ্বের সর্বমঞ্চে অভিনীত হয়েছে (য়্যবার ডি বুনেন ড্যার ভেলট)। ফিলজগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কম, তবে শুনেছি এর ফিল্ম নাকি এদেশেও এসেছিল।
ভাবতে আশ্চর্য বোধহয়, চোদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ের লেখা একটি রোজনামচা কী করে এতখানি খ্যাতি অর্জন করল। এ যেন সেই বালকবীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়, এ কী গো বিস্ময়!
বইখানা যতবার পড়ি ততবার মনে হয় এর পাতার পর পাতা তুলে দিয়ে কত না অশ্রুজল পর্যায়ের সমাপ্তি টানি। কিন্তু স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে সেটা সম্ভবপর নয়। তবে আন্-এর কিছুটা ব্যক্তিগত পরিচয় দেবার জন্য অত্যল্প তুলে দিচ্ছি। কিন্তু তার পূর্বে তুলে দিই আন্ কীভাবে রোজনামচা লেখা রু করেন।
শনিবার, ২০ জুন ১৯৪২ (জর্মনি কর্তৃক হল্যান্ড দখলের দুই বৎসর পরে– লেখক)
আমার ডায়েরি লেখার খেয়াল একটু অদ্ভুত। আমার বয়সী কোনও মেয়ে ডাইরি লেখে বলে তো আমি শুনিনি। আর তেরো বছরের মেয়ের মনের কথা জানবার কারই-বা মাথাব্যথা পড়েছে। কিন্তু তবুও আমি লিখছি। আমার মনের গহনে যেসব ভাব রয়েছে, সেগুলোকে আমি প্রকাশ করতে চাই।
একটি প্রবাদ আছে : মানুষের থেকে কাগজ অনেক বেশি সহিষ্ণু। একদিন নিরানন্দ অলিস্যের মধ্যে গালে হাত দিয়ে যখন ভাবছিলাম, কী করে সময় কাটানো যায়, সেই সময় এই কথাটা আমার মনে এল।
এখন আমার সত্যিকারের বন্ধু কেউ নেই।
এর পর আন্ বলছেন তাঁর বাপ, মা, বোন এবং প্রায় ত্রিশজন বন্ধু আছেন। এবং আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইহুদিরা আসলে প্রাচ্যদেশীয় বলে আমাদেরই মতো শুষ্টিসুখ অনুভব করতে খুবই ভালোবাসে।
তবু আন্ বলেছেন, কিন্তু তবু আমি নিঃসঙ্গ। সুতরাং এই নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্যে আমি এই ডাইরি লিখছি; কিন্তু এই ডাইরি আমি চিঠির আকারে লিখব। আমি এক কাল্পনিক বন্ধু ঠিক করেছি তার নাম কিটি (ইংরেজিতেও কিটি, ক্যারিন –লেখক), আমার এই ডায়েরি কিটিকে লেখা চিঠির আকারে লিপিবদ্ধ হবে।
পাঠকের মনে এস্থলে প্রশ্ন উঠতে পারে, আন্ কি জানতেন তাঁর এ রোজনামচা একদিন প্রকাশিত হবে?
আনকেই বলতে দিন :
বুধবার, ২৯ মার্চ ১৯৪৪
প্রিয় কিটি,
বলকেস্টাইন নামে একজন মন্ত্রী লন্ডন থেকে একদিন বেতার-বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তার বক্তৃতার বিষয় ছিল হল্যান্ডের যুদ্ধের পরিকল্পনা। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বললেন– জর্মন অধিকৃত অঞ্চলের লোকেদের ডায়েরি জোগাড় করতে হবে; তা যদি হয় তা হলে আমার এই ডায়েরির খুব কদর হবে। ভাবতে কী মজাই না লাগছে! বাস্তবিক দশ বছর পরে আমার এই ডাইরি যদি লোক পড়ে (প্রকৃত প্রস্তাবে দশ নয় পাঁচ বছর পরেই বিশ্বজন এই বইখানিকে হৃদয়ে টেনে নিয়ে তার প্রভূততম কদর দিয়েছে লেখক) তা হলে আমরা এখানে কী অবস্থায় কাটিয়েছি, তা জেনে তারা অবাক হবে।
এর দেড় মাস পর আন আবার কিটিকে জানাচ্ছেন :
কিন্তু জীবনের চরম লক্ষ্য সাংবাদিক ও বড় লেখিকা হওয়া– সেকথা মুহূর্তের জন্যেও ভুলি না। আমার এই অলীক আশা কোনওদিন সফল হবে কি না, তা ভবিষ্যই জানে। কিন্তু আমার ডাইরি যুদ্ধ শেষ হলে আমি ছাপিয়ে বার করব- এ সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত।
–তোমারই আন
বস্তুত লেখিকা হতে হলে যে কটি গুণের প্রয়োজন আন্-এর সবকটিই ছিল, কিন্তু বিধাতা তার জন্য রেখেছিলেন অকালমৃত্যু।
জানি না, আমার দরদী পাঠক এর থেকে কোনও সান্ত্বনা পাবেন কি না। যে আন্-এর মৃত্যুর জন্য হিটলার-হিমলার দায়ী, তাদের দুজনকেই আত্মহত্যা করতে হয় আন্-এর মৃত্যুর দু মাসের মধ্যে।
যে নাৎসি নেতা সাইস-ইনভারট ফ্রাঙ্ক পরিবার গ্রেফতার হওয়ার সময় হল্যান্ডের শাসনকর্তা ছিলেন তিনি প্রধানত হল্যান্ডে কৃত তার কুকীর্তির জন্য নরবের্গ মোকদ্দমার বিচারের পর আন্-এর মৃত্যুর দেড় বৎসর পর ঝোলেন ফাঁসি কাঠে। গেস্তাপো নেতা কাটলেন নারও ওইদিন একই পন্থায় ওপারে যান এবং তার সহকর্মী আইকমানকে ফাঁসি দেয় ইহুদিরা কয়েক বৎসর পরে–জরায়েলে।
———-
১. আন তিন-তিনবার তাঁর ডাইরিতে লিখেছেন তার জন্মদিন ১২ জুন। অথচ প্রামাণিক জর্মন বিশ্বকোষ ড্যারগ্রসে ব্ৰহহাউস (১৯৫৮, অ্যারাসুংসবাট, পৃ. ১৫৭) লিখছেন ১৪ জুন। জর্মন-প্রবাসী কোনও বঙ্গসন্তান যদি অনুসন্ধান করে পাকা খবর জানান তবে উপকৃত হই। তবে কি ইহুদি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে চালু ক্যালেন্ডারের কোনও ফেরফার আছে।
মরহুম অধ্যাপক ডক্টর আব্দুল হাই
এ লেখাটি আমাকে লিখতে হবে, এবং আজই লিখতে হবে। অথচ অন্তর্যামী জানেন, এটি লিখতে গিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে আমার অক্ষম লেখনী কতখানি পর্যদস্ত হচ্ছে। ভাবাবেগে আমি এমনই মতিচ্ছন যে অনেক কিছু একসঙ্গে বলতে চাই, এবং শেষ পর্যন্ত কিছুই বলতে পারি না।
সরল পাঠক ভাবে, সাহিত্যিকের ভাবনা কী? ভাষা তার আয়ত্তে, বেদনা হোক, আনন্দ হোক, সে সবকিছুই সহজ সরলতার সঙ্গে প্রকাশ করতে পারে। কথাটা ভুল নয়। কিন্তু এ বিষয়ে মাত্র একটি ব্যত্যয় আছে।