আজকে আবার ওই মুহূর্তগুলোর জন্য প্রতীক্ষা করছি।
–তোমারই আন।
ছেলেটির বয়স তখন মাত্র সাড়ে সতেরো। মনে হচ্ছে, এটি নিষ্পাপ কিশোর-কিশোরীর প্রথম প্রণয়।
এর পূর্বে আন অতিশয় সরলতার সঙ্গে বর্ণনা করেছে তার দেহের বহির্ভাগে বিস্ময়কর যা ঘটেছে, কিন্তু বলছে; দেহের অভ্যন্তরে যা ঘটেছে তা আরও রহস্যঘন বিস্ময়। ইতোমধ্যে আমি তিনবার ঋতুমতী হয়েছি।…এখন আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত সব কামনা জাগছে। কোনও কোনও দিন রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে নিজের স্তনদুটোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে আমার ভীষণ ইচ্ছে হয়। এ বক্ষের ছন্দোময় স্পন্দন শোনবার জন্য আমি কান পেতে থাকি।…।
এস্থলে উদ্ধৃতিটি অসম্পূর্ণ রেখে বলি, ধন্য ধন্য কবীন্দ্র রবীন্দ্র। তিনি কী করে জানলেন বালিকা যখন কিশোরী হয় তখন তার দেহানুভূতি হৃদয়ানুভূতি!
ওগো তুমি পঞ্চদশী,
পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে।
মৃদুশ্রিত স্বপ্নের আভাস তব বিহ্বল রাতে।
ক্বচিৎ জাগরিত বিহঙ্গকাকলী
তব নবযৌবনে উঠিছে আকুলি ক্ষণে ক্ষণে।
প্রথম আষাঢ়ের কেতকীসৌরত তব নিদ্রাতে।
যেন অরণ্যমর্মর
গুঞ্জরি উঠে তব বক্ষে থরথর।
অকারণ বেদনার ছায়া ঘনায় মনের দিগন্তে,
ছলো ছলো জল এনে দেয় তব নয়নপাতে।
এই যে যেন অরণ্যমর্মর গুঞ্জরি উঠে তব বক্ষে থরথর ঠিক সেই অনুভূতিই তো আন্ প্রকাশ করছে যখন সে বলছে এ বক্ষের ছন্দোময় স্পন্দন শোনবার জন্য আমি কান পেতে থাকি।
ততোধিক আশ্চর্য, ঠিক ওই সময়েই প্রেমবোধের সঙ্গে সঙ্গে তার ধর্মবোধও জাগ্রত হয়েছে। তার দয়িত পিটারের কথা ভাবতে ভাবতে বলছে,
এর ওপর আরও বিপদ, ও ধর্ম ও ভগবান মানে। ধর্ম মানুষের এক বিরাট অবলম্বন স্বর্গীয় বিধানের ওপর কজন লোক পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারে
(রবীন্দ্রনাথের আমার গুরুর আসন কাছে/ সুবোধ ছেলে কজন আছে?–লেখক) কিন্তু যারা পারে, তারা সত্যিই সুখী। আর নিজের বিবেক যখন ধর্মের বিধানের সঙ্গে যোগ খেয়ে যায় তখন যে শক্তি ও আনন্দ পাওয়া যায়, তার তুলনা নেই।
এ অধম যুক্তিত। ধর্মের বিধানের সঙ্গে যে প্রায়ই বিবেকের দ্বন্দ্ব লাগে সেটা সে ওই অতি অল্প বয়সে হৃদয়ঙ্গম করল কী করে!
.
বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে ইয়োরোপীয় ইহুদিদের অন্যতম কেন্দ্রভূমি ছিল রাইন নদীর পারের ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর। এরই এক পরিবারে আন্ ফ্রাঙ্কের জন্ম ১২ জুন, ১৯২৯-এ(১)। ১৯৩৩-এ হিটলার গদিনশীন হলে পর আ-এর পিতা সপরিবার হল্যান্ডের আমসটের্ডাম চলে যান। (আইনস্টাইনও ওই বছরে আমেরিকা যান)।
স্বয়ং আন লিখছেন (তখন তার বয়স তেরো : আমাদের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন, যারা জর্মনিতে রয়ে গেছেন তারা নাসিদের হাতে নানাভাবে লাঞ্ছিত হতে লাগলেন। তখন আমার দু-মামা আমেরিকায় পালিয়ে গেলেন। তাদের জন্য আমরা সর্বদাই উদ্বিগ্ন থাকতাম। ১৯৩৮ সালৈ যখন ইহুদিদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা লাগানো রু হল, তখন আমার বুড়ি দিদিমা আমাদের কাছে চলে এলেন। তাঁর বয়স ৭৩।
১৯৪০-এর মে মাস থেকে আরম্ভ হল হল্যান্ডবাসী তাবৎ ইহুদিদের বিপর্যয়। হিটলার হল্যান্ড দখল করে এমন সব আইন পাস করলেন যাতে করে ইহুদিদের জীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠল।
হিটলার হল্যান্ড বিজয়ের দুই বত্সর পরও আন্ লিখছেন :
হাজাররকম বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন কাটতে লাগল। আমাদের স্বাধীনতা বলতে কিছুই রইল না। তবুও তখন অবস্থাটা একেবারে অসহ্য হয়নি।
বেচারি আন্- আন্ কেন, কজন ওই ১৯৪২-এ জানত যে হিটলার ১৯৩৯ সালেই মনস্থির করে গোপনে হুকুম দিয়েছেন, নির্যাতন উৎপীড়ন দিয়ে আরম্ভ করে শেষটায় ইহুদিদের সবংশে ও সমূলে নিধন করতে হবে। বিশেষ করে হল্যান্ড দেশটিতে যেন একটি ইহুদিও জীবন্ত না থাকে।
কিন্তু আন্-এর পিতা বুঝতে পেরেছিলেন যে দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে। ৫ জুলাই ১৯৪২ সালে আন্ লিখেছেন,
একদিন বাবার সঙ্গে পার্কে বেড়াচ্ছিলাম, বাবা হঠাৎ আমাকে বললেন, শোন অন্, এখন যত পারো আনন্দ করে নাও, কেননা খুব তাড়াতাড়ি আমাদের এখান থেকে চলে গিয়ে কোনও নতুন জায়গায় লুকোতে হবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন বাবা, এখান থেকে কোথায় যাব? লুকোতেই-বা হবে কেন? তিনি বললেন, জর্মনরা এসে আমাদের ধরবার আগেই আমরা লুকিয়ে পড়ব। ব্যাপারটা এখনও ভালো করে বুঝতে পারলাম না, কিন্তু একটা অস্পষ্ট বিষাদে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
এর পাঁচ-সাত দিন পরই ফ্রাঙ্ক পরিবারকে তাদের বাসস্থান ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে শহরের অন্যপ্রান্তে চারতলার পিছনের দিকে গুটিকয়েক কুইরিতে গোপন আশ্রয় নিতে হল। এদের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ইহুদি পরিবারও আশ্রয় নেয়। সবসুদ্ধ আটটি প্রাণী। প্রায় দুই বৎসর এখানে লুকিয়ে থাকার পর এদের সকলেই ধরা পড়ে। এর পরের কাহিনী অত্যন্ত মর্মন্তুদ।
এই দুই বত্সর ধরে আন তাঁর ডাইরিটি লিখে যান। যখন ডাইরিটিতে লিখতে আরম্ভ করেন তখন তার বয়স তেরো, যখন ধরা পড়েন তখন তার বয়স পনেরো বত্সর। ষোল পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই আন্ জর্মন কনসানট্রেশন ক্যাম্পে টাইফাস জ্বরে অসহ্য যন্ত্রণা ভুগে মারা যান। তার আঠারো বছরের দিদি মারগট (মারগারেট)-এরও টাইফাস হয়েছিল এবং ক্যাম্পের একই কামরায় রোগ-যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে উপরের বাঙ্ক থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান। ওই একই সময়ে এদের মা-ও ক্যাম্পে মারা যান। তখন তার বয়স পঁয়তাল্লিশের মতো। পরিবারের মাত্র একজন, পিতা অটো দৈববলে অবলীলাক্রমে বেঁচে যান।