কিন্তু এর মাত্র এগার দিন পরেই–
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ,
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ
তাতা থৈথৈ তাতা তৈথৈ তাতা থৈথৈ।
মঙ্গলবার, ৬ জুন, ১৯৪৪ (অর্থাৎ ডি ডে–লেখক)
প্রিয় কিটি,
আজ একটি অবিস্মরণীয় দিন। অবশেষে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলা হল। ফরাসি উপকূলের বিভিন্ন জায়গায় মিত্রপক্ষের সৈন্যদল অবতরণ করছে।…
জর্মনির খবরেও স্বীকার করা হয়েছে যে, ফরাসি উপকূলে ব্রিটিশ প্যারাশুট বাহিনী অবতরণ করেছে।…
আমাদের গোপন আবাস চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সেই বহু প্রতীক্ষিত মুক্তি যা এতদিন আমাদের কাছে ছিল সুদূর স্বপ্নরাজ্যের কাহিনীর মতো, তা কি সত্যিই আমাদের কাছে এল? সত্যিই কি ১৯৪৪ সালের মধ্যে বিজয়লাভ করব?
হতাশার অন্ধকার ছিন্ন করে আবার আশার আলোক জেগেছে।
কিন্তু পাঠক, এর পর দিনের পর দিন, মিত্রশক্তি যেমন যেমন ফ্রান্স জয় করে এগিয়ে আসতে লাগল, আর আন্ সোল্লাসে তার ডাইরিতে সেগুলো লিপিবদ্ধ করল তার উদ্ধৃতি আমি দেব না। আপনারা ডাইরিখানা পড়ে দেখবেন। সে প্রতিদিন আশা করছে মিত্রশক্তি হল্যান্ড জয় করে তাদের মুক্তিদান করবে। এবং এইটুকু বলব, এ যুদ্ধের শেষাঙ্ক সম্বন্ধে যেসব বই লেখা হয়েছে তার মধ্যে আন্ ফ্রাঙ্কের ডাইরি সর্বপ্রথম সর্বপ্রধান পর্যায়ে পড়ে।
কিন্তু হায়! হায়! শেষরক্ষা হল না।
২১ জুলাই আন বেতারে শুনল, হিটলারকে হত্যা করবার চেষ্টা করা হয়েছিল, আর হিটলার হন্যে হয়ে দোষী-নির্দোষী হাজার হাজার জনকে ফাঁসি দিচ্ছেন। আন্ লিখছে, এইরকম করে হতভাগারা যদি নিজেরা মারামারি করে মরে, তা হলে ইংরেজ-আমেরিকা আর রুশদের কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়। আমাকে কি বড় খুশি মনে হচ্ছে সত্যি, আমি যে আনন্দ চেপে রাখতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে এই অক্টোবর মাসেই আবার আমার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে।
একে তুমি আকাশ-কুসুম কল্পনা বলছ? বার্লিনের দিকে ধাবমান সৈন্যদের পদধ্বনি বলছে, না এ আকাশ-কুসুম নয়। এ সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
কিন্তু হায়, পাড়ে এসে ভরাডুবি হল। এর কয়েকদিন পরেই জর্মন পুলিশ আন্দের গুপ্তাবাস আবিষ্কার করে সবাইকে গ্রেফতার করে কনসানট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাল। তার পর কী হয়েছিল সেটা, কঠোর পাঠক, দয়া করে আমাকে পুনরাবৃত্তি করার হুকুম দিও না।
আন্ ফ্রাঙ্ক সম্বন্ধে আমার হয়তো আরও অধিক কিছু লেখাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কারণ ইতোমধ্যেই হাতে-কলমে সপ্রমাণ হয়ে গিয়েছে যে, একাধিক দরদী পাঠক-পাঠিকার দৃষ্টি আন্-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ বাবদে আমার মতো নগণ্য লেখক একজন প্রখ্যাত বাঙালি লেখকের সহৃদয় একখানি চিঠি পেয়েছে। তিনি লিখেছেন :
সম্প্রতি এর্নাকুলাম থেকে একটি মহিলা (ইনি আমার –এর মালায়ালাম অনুবাদ প্রকাশ করেছেন) জানতে চেয়েছেন–আন্ ফ্রাঙ্কের লেখা The Diary of a Young Girl বইখানার বাংলা অনুবাদ কে করেছেন, তার ঠিকানা কী এবং প্রকাশক কারা। এখানে বসে কী করে খবরটা সগ্রহ করা যায় যখন ভাবছি, দেশ পত্রিকার বর্তমান সংখ্যায় আপনার পঞ্চতন্ত্রে এ বিষয়ে অনুবাদকের নাম পেয়ে গেলাম। এদের ঠিকানা কি আপনি জানেন? ইত্যাদি।
আন্ সম্বন্ধে যখন সেই সুদূর কেরালায়ও এতখানি কৌতূহল রয়েছে তখন আমার পক্ষে হয়তো এ নিয়ে আর অত্যধিক বাগৃবিন্যাস করা উচিত হবে না। কিন্তু মাঝে মাঝে কোনও কোনও কাঁচা লেখক একটি বিষয়েই এমনি মজে যান যে, সে দ থেকে আর সহজে বেরুতে পারেন না। আমার হয়েছে তাই। কিংবা বলতে পারেন, একে তো ছিল নাচপাগলী বুড়ি, তার ওপর পেল মৃদঙ্গের তাল। কিংবা তারও বাড়া :
কী কল পাতাইছ তুমি
বিনা বাইদ্দে (বাদ্যে) মাছি আমি!!
অতএব বন্দাশীল পাঠকের সামনে আন্-এর আরও একটু সামান্য পরিচয় নিবেদন করি।
আন্-এর রসিকতাবোধ ছিল অসাধারণ। তার তেরো বৎসর বয়সে ক্লাস টিচার আদেশ দিয়েছেন বাঁচালতা সম্বন্ধে রচনা লিখতে। আন-এর বাঁচালতার শাস্তিস্বরূপ।
ফাউন্টেন পেনের ডগা কামড়াতে কামড়াতে ভাবতে লাগলাম–কী লেখা যায়। হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, বরাদ্দ তিন পাতা লিখে ফেলে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করলুম। আমার যুক্তি হল, বক বক করা নারীজাতির বৈশিষ্ট্য। যদিও বাঁচালতাকে সংযত করার চেষ্টা করা উচিত, তবুও এই দোষ থেকে আমার একেবারে মুক্ত হওয়া উচিত হবে না, কারণ আমার মা, আমারই মতো এবং সময় সময় আমার চেয়েও বেশি কথা বলেন। সুতরাং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত স্বভাবধর্ম কী করে ত্যাগ করতে পারি আমার যুক্তি শুনে মি. কেল্টরকে (শিক্ষককে) হাসতে হল।
আমরাও হাসছি। কিন্তু আন্-এর শেষ দুর্গতির কথা স্মরণে আছে বলে চোখের জলের ফাঁকে ফাঁকে। সেই প্রাচীন দিনের এক হতভাগ্যের গান,
I am dancing with tears in my eyes.
সবেমাত্র চৌদ্দ বছর পূর্ণ হওয়ার সময় আন্ তাদেরই সঙ্গে লুক্কায়িত একটি ইহুদি ছোকরার প্রেমে পড়ে। তখন লিখছে– আমি কেটে-হেঁটে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করছি।
রবিবার, ১৬ এপ্রিল ১৯৪৪
প্রিয় কিটি,
কালকের দিনটা আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। প্রথম চুম্বন। প্রত্যেক মেয়ের জীবনেই এক স্মরণীয় ঘটনা এবং সেই জন্যেই কালকের দিনটা আমার চিরকাল মনে থাকবে। কাল সন্ধ্যাবেলা পিটারের ঘরে আমরা দুজনা চৌকির উপর বসে ছিলাম। খানিকক্ষণ পরে ও আমার কাঁধের উপর হাত রাখল। আমিও ওর কোমর জড়িয়ে ধরলাম। ও তখন আমাকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল। এর আগেও আমরা অনেকবার এইরকম পরস্পরকে জড়িয়ে বসেছি, কিন্তু এবার আমার সান্নিধ্য অনেক নিবিড় ও উষ্ণ। আমার বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছিল।… ওই সময় আমার যে কী আনন্দ হচ্ছিল, তা লিখে বোঝাতে পারব না… তার পরের মুহূর্তগুলো আমার ঠিক মনে নেই। নিচের দিকে যাবার জন্য যখন পা বাড়িয়েছি, ও তখন হঠাৎ আমায় চেপে ধরে আমার কপাল, গালে, গলায় এবং বুকে বার বার চুমু খেতে লাগল। আমি কোনওরকমে ওর হাত ছাড়িয়ে ছুটে নিচে পালিয়ে এলাম।