ইতোমধ্যে আবার জর্মন ভাষার অধ্যাপক ছুটিতে চলে যাওয়ার দরুন বেনওয়া সায়েবের ঘাড়েই পড়ল জর্মন শেখাবার ভার, এবং তিনিও ফরাসি মডার্ন কবিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়াতে আরম্ভ করলেন জর্মন মডার্ন কবিদের মডার্নতম রাইনের মারিয়া রিলুকে! সে আরেক নিদারুণ অভিজ্ঞতা, সুকুমার রায়ের ভাষায় ভুক্তভোগী জানে তাহা, অপরে বুঝিবে কিসে?–সে-কাহিনী আরেক দিনের জন্য মুলতবি রইল। শুধু এইটুকু নিবেদন, চেষ্টা দিয়েছিলুম, স্যর, সেই সতেরো-আঠেরো বছর বয়সেই চেষ্টা দিয়েছিলুম, এই কবিতা নামক জিনিসটির রসাস্বাদন করার। আর যে দোষ দেবেন দিন, শুধু এইটুকু বলবেন না যে, বুড়ো-হাবড়া হয়ে যাবার পর মডার্ন কবিতার প্রেম কামনা করে হতাশ-প্রেমিকরূপে পরিবর্তিত হয়েছি।
তার পর এল সেই শুভলগ্ন যেদিন মডার্ন কবিতার সঙ্গে আমাদের তালাকটি বেনওয়া সাহেব মঞ্জুর করলেন। আমরা সোল্লাসে ফিরে গেলুম দোদে, ফ্লুবেরের কাছে। শুনেছি, স্পেনের লোক নাকি বছরের প্রথম দিন এক গেলাস জল নিয়ে তাতে কড়ে আঙুলের ডগাটি ডুবিয়ে সেই আঙুল জিতে লাগিয়ে অতি সন্তর্পণে সভয়ে চাটার পর আঁতকে উঠে বলে, ওই সেই প্রাচীন দিনের পুরনো বিস্বাদ বস্তু; চ, ভাই, ফিরে যাই আমাদের মদের গেলাসেই। কেন যে পাদ্রি সায়েব মদ কমাতে আর বেশি জল খেতে বলেন বোঝা ভার। আমরাও স্পানিয়ার্ডদের মতো ফিরে গেলুম আমাদের ক্লাসিক্স-মদ্যে।
আমাদের মুখের ভাব দেখে নেওয়া সায়েব হেসে বললেন, তবু তো আমরা আছি ভালো, কারণ আমরা চর্চা করি সাহিত্যের। সেখানে উল্কষ্টে-নিকৃষ্ট পার্থক্য করা তেমন কিছু অসম্ভব কঠিন নয়। সেখানে রুচিবোধের অনেকখানি স্থিরতা আছে। কিন্তু হত যদি আমাদের বিষয়বস্তু চিত্র? তা হলে খানিকটে আভাস পেতে সে-ক্ষেত্রে রুচির কী আকাশ-পাতাল পরিবর্তন হয় রাতারাতি। আজ যার ছবি ভোলা নিলামে বিক্রি হল লক্ষ ডলারে, বছর ঘুরতে-না-ঘুরতে সেই ছবিই বিক্রি হল হাজার ডলারে। আজ যাকে বলা হচ্ছে গ্রামের গ্র্যান্ড মাস্টার বা মেসরো (ওস্তাদের ওস্তাদ) তিন বছর যেতে-না-যেতে তাঁর ছবি হয়ে গেল বিল, পিফল (রদি, চোতা)!আর এসব ছবিই কিন্তু অ্যাকাডেমিক স্টাইলে আঁকা; কোনও নতুন এক্সপেরিমেন্টের কথা উঠছে না।
তবেই ধারণা করতে পারবে মডার্ন পেন্টিং নিয়ে কী অসম্ভব রুচি পরিবর্তন, রীতিমতো খুনোখুনি মারামারি। আর সে ছবিগুলোতে আছে কী? ধোয়াটে, তামাটে, বিকুটে কী যেন কী, জানেন শুধু আটিই, বা হয়তো তার অন্তরঙ্গ সখামণ্ডলী, এতে আছে কী, আর্টিস্টের উদ্দেশ্য কী নিচে লেখা বসন্ত। আর, আজ ফার অ্যাজ আই অ্যাম্ কনসার্নড় সেখানে বসন্ত না লিখে অভিধানের ভিতরের বা বাইরের যে কোনও শব্দ লিখলেও আমার তাতে সুবিধা-অসুবিধা কিছুই হয় না। অধিকাংশ আর্টিস্টই আবার তাদের ছবির কোনও নামই দেন না। বলেন, তারা নাকি ডিক্সনারি ইলাসট্রেট করার জন্য আঁকেন না।
বেনওয়া সাহেব সেদিন আরও অনেক খাঁটি তত্ত্বকথা বলেছিলেন। কারণ খাস ফরাসিদের মতো তাঁর কৌতূহল ও উত্সাহ ছিল–কাব্য, সঙ্গীত, চিত্র, ভাস্কর্য ইত্যাদি নানা রসের নানা প্রকাশে, নানা বিকাশে। সর্বশেষ তিনি ইমপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম, কুবিজম, দাদাইজম ইত্যাদি বহুবিধ ইজম-এর ইতিহাস শোনানোর পর শেষ করলেন বানরালের কীর্তিকাহিনী শুনিয়ে।
কাহিনীটি আমার চোখের সামনে আজও জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয় নাটকের যিনি হিরো তার নামটি ভুলে গিয়েছি। বানরালে-বানরালে গোছ কী যেন এক বিজাতীয় নাম– এ নামটা অনায়াসে আমারও হতে পারত, তবে এটুকু মনে আছে যে নামের মধ্যিখানে আন্ কথাটি ছিল। অবশ্য এ নাট্যের আদ্যন্ত আজও অতি সহজেই আবিষ্কার করা সম্ভবে, সামান্য কয়েক মাস কলকাতা-দিল্লি-বোম্বাই (এ ব্যাপারে বোম্বাই কোন পুণ্যবলে তীর্থভূমিতে পরিণত হলেন সে রহস্য পূতভূমির পাণ্ডারাও জানেন না) মাকু মারার পর নিরাশ হয়ে, শেষটায় ভিটেমাটি বেচে, কালোবাজারে ফরেন এক্সচেঞ্জ কিনে যদি প্যারিস চলে যান (ভুলবেন না, ফেরার সময় ম পলিয়ে থেকে একটা ডিলিট নিয়ে আসবেন; এদেশে কাজে লাগবে। প্ল্যাটফর্মেই বোধহয় সনদ বিক্রি হয়, নইলে হয়তো দু-একদিন বিশ্ববিদ্যালয়-পাড়ায় বাস করে, রেডিমেড থিসিস কিনে সেটা পেশ করা মাত্রই সনদটা পেয়ে যাবেন সঙ্গে সঙ্গে…ডট করা লাইনের সঠিক জায়গায় নাম সই করতে কিংবা টিপসই দিতে যেন ক্রটি না হয়…) তবে অদ্যকার বঙ্গসন্তানমাত্রই আনন্দিত হবে যে, কালোবাজার সেখানে নেই (সব খোলাখুলি, সামনাসামনি)।
প্যারিসের লোক সে কাহিনী এখনও ভোলেনি। আপনাকে নতুন করে বলার সুযোগ পেয়ে বড়ই উৎসাহের সঙ্গে সেটি কীর্তন করবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন মডার্ন আর্ট প্যারিসের অন্যসব প্রাচীন অর্বাচীন কলাসৃষ্টিকে ঝেটিয়ে মহানগরী থেকে বের করে দিয়েছে, তখন হঠাৎ একদিন উদয় হলেন গটগট করে, সূর্যোদয়ের গৌরব নিয়ে এই চিত্রকর চিত্রকর বললে অত্যল্পই বলা হয় যেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। এতদিন নাকি নির্জনে চিত্রসাধনায় নিযুক্ত ছিলেন বলে কোনও প্রদর্শনীতে ছবি পাঠাননি। কিন্তু এইবারে তার সময় হয়েছে। কারণ মডার্ন আর্ট তার নতুন পথ খুঁজে পেয়েছে, তার চরম সিদ্ধিতে পৌঁছে গেছে এরই চিত্রকলায়।