ফিল্মও হয়েছে। তারই বদৌলত যাদের যুদ্ধ বাবদে কৌতূহল সীমাবদ্ধ তাঁরাও অনেকখানি ওয়াকিফহাল হয়ে গিয়েছেন। যদ্যপি ফিল্মটি বড়ই একপেশে ও অসম্পূর্ণ। কিন্তু সুশীল পাঠক তোমাকে অভয় দিচ্ছি, আমি এ কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করব না যেসব মহারথীরা এ বিষয়ে বিরাট বিরাট ভুলুম ভুলুম কেতাব লিখেছেন পার্কার শিফার ম ব্লা ফাউনটেন পেন দিয়ে তার সঙ্গে পাল্লা দেবে আমার ভোতা কঞ্চির কলম।
আমার বর্তমান উদ্দেশ্য ভিন্ন।
ওই ১৯৪৪ সালের মার্কিনিংরেজ অভিযানের প্রায় দেড়-দুই বৎসর পূর্বের থেকেই সারা ইয়োরোপময়–এমনকি প্রাচ্যে– জল্পনা-কল্পনা হচ্ছিল ওরা জনিকে হুড়ো দেবার জন্য ইংলিশ চ্যানেল ক্রস করে জর্মন নির্মিত আটলানটিক উয়োলে হানা দেবে কবে, কোন জায়গায় এই জল্পনা-কল্পনা সর্বাপেক্ষা উল্কণ্ঠ আকণ্ঠ আগ্রহে, আশা-নিরাশার দোদুল্যমান ইয়োরোপের সর্বত্র লুক্কায়িত কিংবা কনসানট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি ইহুদিরাই ছিল প্রধানতম।
আন ফ্রাঙ্ক তার ডাইরিতে মার্চ মাসে অর্থাৎ ডি ডের তিন মাস পূর্বে লিখছে :সেটা ছিল রবিবার, রাত্রি নটা। উইনস্টন চার্চিল সেদিন বেতার বক্তৃতা দিয়েছিলেন সে বক্তৃতার মধ্যে সত্যিকারের আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম। তার মধ্যে মিথ্যা বাগাড়ম্বর ছিল না–ছিল হিটলার-নিপীড়িত অগণিত নরনারীর প্রতি অশ্বাসের বাণী। সেই সময়টা মনে হয়েছিল যে আমাদের এই গোপন-আবাসে আমরা অসহায় ও নিঃসঙ্গ নই। এক বিশাল দুনিয়া জুড়ে আমাদের উদ্ধার করার জন্য তোড়জোড় চলছে।
কিন্তু আন্ সরলা হলেও এ বাবদে রীতিমতো বুদ্ধিমতী। ওই গোপন আবাসে যে আটটি প্রাণী প্রতিদিন জল্পনা-কল্পনা করছে তার নীর সরিয়ে ক্ষীরটুকু সযত্নে সংগ্রহ করে তার ডাইরিতে লিখে রাখছে, এদের ভিতর বয়সে যে সবচেয়ে ছোট, সেই আন্। আর খাসা রসিয়ে রসিয়ে
একজন হয়তো বলল, কয়েকদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলা হবে। ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে আক্রমণ করা কি এতই সোজা! আবার একজন বলল, একবার ফ্রান্সে নামতে পারলে, এক মাসের মধ্যে বার্লিন পৌঁছে যাবে। আর একজন রণবিশারদ বলে উঠলেন, এক বৎসরের কম কিছুতেই বার্লিন পৌঁছতে পারবে না। আন্ এর অভিমত দিয়ে এ অনুচ্ছেদ শেষ করেছে। এবং এর কথা আখেরে ফলেছিল। ডি ডে হয় ৬ জুন; তার এগারো মাস পরে ৮ মে জমনি বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করে। যাহা বাহান্ন, তাহা তিপ্পান্ন, ইংরেজিতে নাকি সিসেস্ অ্যান্ড সেনে, ফারসিতে শশ (ষষ্ঠ) ও পন্জ (পঞ্চ) বলে– অবশ্য অল্প ভিন্নার্থে। মোদ্দা : এগারো মাস যা, বারো মাস তা।
কিন্তু এইমাত্র বলেছি, আন্ সুচতুরা বালা।
কারণ যদ্যপি সে বলেছে, এক বিশাল দুনিয়া জুড়ে আমাদের উদ্ধার করবার জন্য তোড়জোড় চলেছে, তথাপি যে অন্তরে অন্তরে জানে মার্কিনিংরেজ বাবুরা নিছক খয়রাতি কর্ম করার জন্য, দুহাতে চ্যারিটেবল হসপিটাল ছড়াতে ছড়াতে ডি ডেতে ফ্রান্সে নামবেন না। তাই এই দিবসের এক মাস পূর্বে লিখছে, আমাদের এখানে সকলেই এখন আশা করছে যে, মিত্রপক্ষের (অর্থাৎ মার্কিনিংরেজ) অভিযান খুব তাড়াতাড়ি আরম্ভ হবে; কারণ রাশিয়া সমস্ত ইউরোপ দখল করে নেবে, এ তারা কিছুতেই হতে দেবে না।
অতিশয় হক কথা। আন্ এই বয়সেই বাবুদের সচ্চরিত্রের কিছুটা চিনে গিয়েছে, নিছক ঈশ্বরপ্রসাদাৎ! আমরা ইংরেজকে বিলক্ষণ চিনি, চোখের জলে নাকের জলে হাড়ে হাড়ে।
কিন্তু মুক্তি পাবার আশা উষ্ঠা উত্তেজনার মাঝখানেও দেখুন, এই কুমারীটি কীরকম শান্তভাবে উভয় পক্ষের দায়িত্ব ওজন করে দেখছে। ডি ডের ঠিক এক পক্ষ পূর্বে সে লিখছে : ..আশা এবং উষ্ঠা চরমে পৌঁছে গেছে। কেন এখনও আক্রমণ হচ্ছে না, ইংরেজরা কেন এত দেরি করছে, তারা কি কেবল তাদের নিজের দেশের জন্য লড়ছে, হল্যান্ডের প্রতি কি তাদের কোনও দায়িত্ব নেই। কিন্তু ইংরেজদের আমাদের প্রতি কীই-বা দায়িত্ব আছে। আমরা আমাদের নিজেদের মুক্তির জন্য কতটুকু চেষ্টা করেছি। জর্মন অধিকৃত দেশগুলোর মধ্যে কবার কটা বিদ্রোহ হয়েছে। নিজের মুক্তি নিজেরই অর্জন করতে হয়– অন্য দেশের কী মাথাব্যথা পড়েছে যে, কেবলমাত্র আমাদের উদ্ধার করার জন্যে সৈন্যসামন্ত পাঠাবে আক্রমণ একদিন হবেই, কিন্তু তা আমরা চাইছি বলে নয়, ইংরেজ এবং আমেরিকার নিজেদের স্বার্থে।
এই চরম দ্বন্দ্বের মাঝখানে মেয়েটির ভগবানে বিশ্বাস, অন্তিমে সত্যের সর্বজয় সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ প্রত্যয় এবং সর্বোপরি তমসাচ্ছন্ন পাশ্চাত্যে নবীন উষার উদয়, নবীন জীবনের অত্যুদয় সম্বন্ধে এ বালাটির পরিপূর্ণ আশাবাদ– তার পরিচয় আমার এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে কিছুতেই প্রকাশ পাবে না।
তবু মাঝে মাঝে মেয়েটি কিন্তু ভেঙে পড়ত।
একদিন লিখছে, প্রিয় কিটি, এক নিদারুণ হতাশা এবং অবসাদ আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে যে এ যুদ্ধ বুঝি আর কখনও শেষ হবে না। যুদ্ধ মিটে যাওয়া যেন বহু দূরের রূপকথার রাজ্যের ব্যাপার বলে এখন মনে হচ্ছে। তার দেড় মাস পরে বলছে, আবার আমার অবস্থা ভেঙে পড়বার মতো হয়েছে। এই গোপন আবাসে এখন সবই বিষাদময়।… হয় মুক্তি, নয় মৃত্যু–দুটোর যে কোনও একটা তাড়াতাড়ি ঘটুক। ভগবান এই আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা থেকে আমাদের রেহাই দাও।
—তোমারই আন