অস্মদ্দেশীয় কাহিনীতে চেলা ভূতকে ডেকে বলল, আমার জন্য একটা রাজপ্রাসাদ তৈরি করে দাও। দু-মিনিট যেতে না যেতেই রাজপ্রাসাদ চোখের সামনে তৈরি। ভূত বলল, তার পরের হুকুম চেলা তো তাজ্জব। তাড়াতাড়ি বলল, গোটা দশেক সুন্দরী রমণী। ভূত কটমটিয়ে তাকিয়ে বলল, সে তো প্রাসাদে অলরেডি রয়েছে। বুদু! হেরেম ভিন্ন প্রাসাদ হয় নাকি? চেলা বলল, তা হলে প্রাসাদের সামনে একটা হ্রদ তৈরি করে দাও। এক মিনিটে তৈরি। ভূত শুধোল, তার পরের কাজ? চেলা তখন আরও মেলাই অর্ডার দিল। সেগুলোও ঝটপট হয়ে গেল। আর প্রতিবারেই ভূত তার কাছে এসে কটমটিয়ে তাকায়। ভাবখানা সুস্পষ্ট। কাজ না দিতে পারলে শর্তানুযায়ী তোমার ঘাড়টা মটাস করে ভাঙব। চেলা তখন পড়েছে মহাসঙ্কটে। নতুন অর্ডার খুঁজে পায় না। কবি গ্যোটের চেলার মতোই সে ভূত বিদায় দিতে জানে না। তখন হন্যে হয়ে, না পেরে, কবি গ্যোটেরই চেলার মতো সে তার গুরুকে স্মরণ করল।
এইখানেই আমাদের কাহিনী গ্যোটের কাহিনীর চেয়ে ঢের সরেস।
আমাদের গুরু তার প্রাচীনতার, ফাস্ট প্রেফারেন্সের দোহাই পাড়লেন না। চেলাকে বললেন, ভূতকে হুকুম দাও একটা বাঁশ পুঁততে। সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল। শুরু চেলাকে বললেন, এবারে ভূতকে হুকুম দাও, সে যেন ওই বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠে। এবং উপরে ওঠামাত্রই যেন নিচে বেয়ে নামে। ফের উপর। ফের নিচে। ফের উপর। ফের নিচ।
গুরু চেলাকে কানে কানে বললেন, ওই করুক, ব্যাটা অনন্ত কাল অবধি। অবশ্য যখন তোমার অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় তখন তাকে ওঠানামা ক্ষণতরে ক্ষান্ত দিয়ে সে কাজ করতে বলবে। তার পর ফের হুকুম দেবে, ওঠো নামো, ওঠো নামো।
কিন্তু এহ বাহ্য।
এ-গল্পের একটা গভীর অর্থ আছে।
মানুষের মন ওই ভূতের মতো। তাকে সর্বক্ষণ কোনও কর্মে নিয়োজিত না করতে পারলে সে তোমার ঘাড় মটকাবে। ইংরেজিতে তাই প্রবাদ অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। অতএব যখন যা দরকার মনকে দিয়ে তাই করিয়ে নিয়ে ফের তাকে একটা বাঁশে ওঠানামার মতো মেকানিকাল কাজে লাগিয়ে দিতে হয়। মানুষ সর্বক্ষণ মনের জন্য নতুন নতুন কাজ সৃষ্টি করতে পারে না।
এইবারে, সর্বশেষে, আমি শান্তনু পাঠকের হাতে খাবো কিল।
মহাত্মাজি চরকা কাটতেন।
রবীন্দ্রনাথ আপন লেখার কপি করতেন। গোরার মতো বিরাট গ্রন্থ তিনি তিন-তিনবার কপি করেছেন। যদিও ওই মেকানিকাল কর্ম করার জন্য আশ্রমে লোকাভাব ছিল না।
আইনস্টাইন ব্যালা বাজাতেন।
বিশ্বভারতী প্রাগ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বভারতীর জন্য এদেশে বিশ্ববিখ্যাত একাধিক পণ্ডিত আনিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামা ছিলেন অধ্যাপক মরিৎস্ ভিটারনিস। একে এদের অনেক সংস্কৃতপণ্ডিত চিনতে পারবেন। ১৯০৯ থেকে ১৯২২ জুড়ে জর্মন ভাষায় প্রকাশিত হয় তার ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস। এরই ইংরেজি অনুবাদ বেরোয় এদেশে ১৯২৭ থেকে ১৯৩২। এছাড়া আছে, গৃহ্যসূত্র প্রাচীন ভারতে বিবাহ অনুষ্ঠান ভারতীয় ধর্মে রমণী ইত্যাদি তার প্রচুর গ্রন্থরাজি।
এ সবকটি বই-ই পণ্ডিতদের জন্য।
কিন্তু তিনি আমাদের মতো সাধারণজনদের একখানি পুস্তিকা লিখে গিয়েছেন–কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে। এ-পুস্তিকা সম্বন্ধে ইতোপূর্বে, অন্য অবকাশে, আমি দু-একটি কথা বলেছি। এস্থলে পুনরায় বলি, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত যত লেখা বেরিয়েছে তার ভিতরে আমি এটিকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করি। তার প্রধান কারণ অধ্যাপকের সমস্ত জীবন কাটে বেদ, উপনিষদ, সংস্কৃত কাব্য নিয়ে। এদেরই ভেতর দিয়ে যে ঐতিহ্য ভারতবর্ষে চলে আসছে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কতখানি সংযুক্ত, কতখানি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তার ধর্মমত কীভাবে গড়ে উঠেছিল এ সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি বলার অধিকার ছিল অধ্যাপক তিনটারনিৎসেরই। তিনি বাংলা ভাষা জানতেন।
বইখানি অতিশয় সরল জর্মন ভাষায় রচিত। ইংরেজি বা বাংলায় এর অনুবাদ হয়েছে বলে শুনিনি। হওয়া উচিত। বইখানি একখণ্ড শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনাথ ভবনে আছে।
চেকোস্লোভাকিয়ার জনসাধারণ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীয় জর্মন এবং পরবর্তী যুগে খাস জর্মনির জর্মনগণ দ্বারা নিপীড়িত হওয়া সত্ত্বেও তাদের কৃষ্টি-সভ্যতার অনেকখানি জন সভ্যতার কাছে ঋণী। তাছাড়া অনেক জর্মনও চেকোস্লোভাকিয়ায় বাস করত।
অধ্যাপক ভিনটারনিৎস চেক নন। তিনি জন্মেছিলেন দক্ষিণ অস্ট্রিয়ায় ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি যখন টুকরো টুকরো হয়ে যায় তখন তার জন্মভূমি পড়ে নবনির্মিত রাষ্ট্র চেকোস্লোভাকিয়ার প্রত্যন্ত প্রদেশে, অবশ্য অস্ট্রিয়াই (হিটলারেরও জন্ম এই অঞ্চলে এবং তার ধমনীতে নাকি কিঞ্চিৎ চেক রক্তও ছিল; মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, চেকদের যে তিনি সর্বনাশ করতে চেয়েছিলেন তার কারণ, ওই করে তিনি তাঁর চেক রক্ত অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, সেইটে আসল কথা নয়। তিনি ভালোবাসতেন প্রাগ শহরকে। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সেখানে তিনি অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে চেকোস্লোভাকিয়া জন্মগ্রহণ করে মাত-উদর থেকে যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তখন তিনি ইচ্ছে করলেই ভিয়েনা (এইমাত্র বলেছি, তার মাতৃভূমি পড়েছিল অস্ট্রিয়ায় এবং অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা তখন প্রাগ ইত্যাদি শহর থেকে তার আপনজনকে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে) বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যেতে পারতেন কিন্তু তিনি যাননি।