কিন্তু প্রশ্ন, প্রবন্ধের গোড়াতেই জামাইষষ্ঠীর কথা তুলেছিলুম কেন?
শুনেছি, সঠিক বলতে পারব না, গায়ের পণ্ডিতদের নিমন্ত্রণ করে বছরে একদিন শহরে এনে ওই যে বিরাট বিরাট সভা করা হয়, ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলা হয় তখন জামাইষষ্ঠীর দিনের মতো তাদেরকে একপেট খেতেও দেওয়া হয় না।
এবং তৎপর ৩৬৪ দিনের গোরস্তানের নীরবতা।
.
এই শেষ নয়। দাঁড়ান না। সুযোগ পেলে আরেকদিন আরেক হাত আমি নেবই নেব।
স্বামী বিবেকানন্দকে গুরু মেনে, সাক্ষী মেনে।
———-
১. আমার প্রতি অকারণ সহৃদয় পাঠক, যারা আশকথা-পাশকথা শুনতে ভালোবাসেন, তাঁদের কাছে অবান্তর একটি ঘটনার উল্লেখ। আমার বৃদ্ধ পিতা তখন ছোট একটি মহকুমার অনারারি হাকিম। একদিন আদালত থেকে ফিরে আমায় বললেন, সিতু, আজ আদালতে কী হয়েছিল, জানিস? এক মূর্ব আরেক গাধার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা এনেছে ওই দোসরাটা নাকি তাকে সদর রাস্তায় শালা বলে গালাগালি দিয়েছে (এতদিন পরে আমার মনে নেই সেটা এবুজিত ল্যানইজ না ডিফেমেশন ছিল– লেখক)। তার পর বাবা বললেন, আসামি পক্ষে মোক্তারের বক্তব্য, যাকে সে শালা বলেছে সে সম্পর্কে সত্যিই তার শালা; অতএব কোনও অপরাধ হয়নি। বিপক্ষ কিন্তু বলছে, রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আসামি যখন শালা বলেছে তখন মধুভরা সোহাগ-পোরা সে শালা বলেনি; বলেছে অপমান করার জন্য। ইতোমধ্যে বাবার মগরিবের (সন্ধ্যার নামাজের জন্য অজুর জল এসে গিয়েছে। আমি তাই তাড়াতাড়ি শুধোলুম, আপনি কী রায় দিলেন? বাবা বললেন, দুই পক্ষকে আদালত থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলুম। বললুম, মশকরা করার জায়গা পাওনি!… আমার মনে এখন সন্দেহ জাগে, বাবার এই হুকুম ঠিক আইনসম্মত হয়েছিল কি না। তবে একথা জানি, দুই পক্ষই কোনও প্রতিবাদ না জানিয়ে সুড় করে বেরিয়ে গিয়েছিল। কারণ বাবা ছিলেন রাশভারী, আচারনিষ্ঠ বৃদ্ধ। আসামি ফরিয়াদি মোক্তার সবাইকে দেখেছেন উলঙ্গাবস্থায় আমাদের বাড়ির আঙিনায় বেলাধুলো করতে।
বনে ভূত না মনে ভূত
আমাকে অনেকেই জিগ্যেস করেন, দেশ-বিদেশ তো অনেক ঘুরলেন, বয়সও হয়েছে, অতিপ্রাকৃত অলৌকিক কিছু দেখেছেন কি? সোজা বাংলায় ভূত, প্রেত, মামদো (মানুষ মরে ভূত হয় এটা ইসলাম অস্বীকার করে কিন্তু কোনও কোনও হিন্দুর বিশ্বাস অয়, অয় রনিতি পার না। মুহম্মদি মানুষ অর্থাৎ মুসলমান মরে গিয়ে মামদো হয়– মুহম্মদি শব্দ গ্রাম্য বাংলায় হয়ে গিয়েছে মামদো। এস্থলে Zনতি কথাটা ঠিক ঠিক ব্যবহৃত হয়েছে কারণ মামদো বলুন, ভূত বলুন, এনাদের তো চট করে চোখে দেখা যায় না– অতএব এনারা আছেন, ওনারাও আছেন, শুধু আমরা Zনতি পারি না এবং অন্যান্য বিভিন্ন জাতবেজাতের ভূতের কোনও একটা আমি দেখেছি কি না?
জর্মন ভাষায় দুটি শব্দ বাংলায় বেশ চালু হয়ে গিয়েছে। একটা কিন্ডারগার্টেন আরেকটা যদিও অতখানি চালু না– রিভারপেস্ট পশুচিকিত্সক মাত্রই চেনেন। আরেকটি শব্দ প্রচলিত হওয়ার বড়ই প্রয়োজন– পটারগাইস্ট। ভুতুড়ে বাড়িতে যে দমাদ্দম ইটপাটকেল এবং মাঝেমধ্যে কচুপাতায় মোড়া নোংরা বস্তুও বর্ষিত হয় সেটি করেন পন্টারগাই। পটার ক্রিয়ার অর্থ দুদ্দাড় দুমদাম শব্দ করা আর গাইষ্ট = ইংরিজি গোস্ট (ghost)।
এর থেকে আরেকটা তত্ত্ব সুস্পষ্ট হয়। ভূত-প্রেত সম্বন্ধে দেশ-বিদেশের যেখান থেকেই হোক না কেন, কোনও গুজব, জনরব– একুনে শুজোরব– পৌঁছনোমাত্রই সরল মানুষ সঙ্গে সঙ্গে সেটা বিশ্বাস করে ফেলে এবং সেই নয়া ভূতকে অবিচারে জাতে তুলে নেয়। ইংরেজের মতো অবিশ্বাসী (অনবিলিভিং টমাস) জাতও তাই তার দুশমন জর্মন জাতের পটারগাইন্টকে আলিঙ্গন করে আপন ভাষায় স্থান দিয়েছে। বিশ্বাস না হয়, যে কোনও ইংরেজি দিকসুন্দরীর (যে সুন্দরী নারী দিক দেখিয়ে দেন, অর্থাৎ ডিশনারি) আশ্রয় গ্রহণ করে সন্দেহ ভঞ্জন করুম। প্রেসিদ্ধ কোনও কোনও গুণীন নাকি ভূতপ্রেতকে দিয়ে অনেক কিছু কাজকর্ম করিয়ে নেন। মহাত্মা কালীপ্রসন্ন তার নক্শাতে এদের সম্বন্ধে সবিস্তার তাজ্জব বয়ান দিয়েছেন। কোনও কোনও পীর সাহেবও নাকি এখনও এই অলৌকিক তিলিসমাৎ দেখাতে পারেন। শীতকালে বোম্বাই আম, যে কোনও কালে কাবুলি মেওয়া পয়দা করতে পারেন।
দুঃখের বিষয় মহাকবি গ্যোটের সেই সুন্দর কবিতাটি আমি ভুলে গিয়েছি। যদূর মনে পড়ছে তাতে এক চেলা পরিপূর্ণ ভূতসিদ্ধ হওয়ার পূর্বেই উচাটন মন্ত্রে ভূতকে আবাহন জানায়। তার পর কী একটা হুকুম করে–খুব সম্ভব জল আনতে–তার পর ভূত জল আনছে তো আছেই, জলে জলে ছয়লাপ। ওদিকে বিপদ হয়েছে কী, চেলা কিন্তু গুরুর কাছ থেকে শেষ উচাটন মন্ত্রটি যেটি দিয়ে ভূতকে ঠেকাবে, সেটি শেখার পূর্বেই চলে এসেছে। এখন বন্যার জলে ডুবে মরে আর কি!… শেষটায় কাতরকণ্ঠে সে গুরুকে স্মরণ করল। গুরু এসে এই ভূতকে অন্য হুকুম দিলেন, আমি এসব চ্যাংড়াদের গুরু। প্রথমে আমার মোক্ষম হুকুম শোন। তার পর অন্য কাজ। এই বলে তিনি ভূতকে অন্য হুকুম দিয়ে বন্যা বন্ধ করলেন।
কিন্তু এ বাবদে আমাদের দেশে প্রচলিত গল্পটি এরচেয়ে ঢের ঢের ভালো। সে গল্পের গোড়াপত্তন ওই একই। আমাদের গল্পে গুরুর কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিদ্যা আয়ত্ত করার পূর্বেই চেলা তার ভূতকে আবাহন করেছে। ভূতের সঙ্গে তার কিন্তু একটা শর্ত ছিল। ভূতকে সর্বক্ষণ কোনওকিছু একটা কাজ দিতে হবে। সে বেকার থাকতে পারে না। কাজ না দিতে পারলে সে ওর ঘাড়টি মটকে দেবে।