পাঠক শুধোবেন, তা হলে ক্লাসে কি অধ্যাপক সেগুলো বুঝিয়ে দিতেন না? এবারে ফেললেন মুশকিলে। সাহেব মোটামুটি একটি ইংরেজি অনুবাদ খাড়া করে দিতেন– কারণ ইংরেজি ও ফরাসির শব্দসম্পদ বিশেষ করে চিন্তা ও অনুভূতি সংশ্লিষ্ট বিমূর্ত শব্দ একই ভাণ্ডার থেকে নেওয়া হয় বলে বহু কবিতার শতকরা ষাটটি শব্দ দুই ভাষাতেই এক। অনুবাদ করা কঠিন নয়। কিন্তু তাই বলেই কি জিনিসটা সরল হয়ে যাবে? মডার্ন বাংলা কবিতার শব্দগুলো তো আপনি চেনেন, তাই বলে কি অর্থ বোধগম্য হয় তার ওপর সর্বক্ষণ ভয়, এখনও তো মামুলি ফরাসিটাই ঠিকমতো রপ্ত হয়নি, হয়তো গাড়োলের মতো এমন প্রশ্ন গুধিয়ে বসব যেটা বাঙলায় প্রকাশ করতে হলে বলি, সওকাও রামায়ণ পড়ে- ইত্যাদি।
তবে দুটো জিনিস লক্ষ করলুম। শোলডার শ্রা করা বা কাঁধ উঠিয়ে-নামিয়ে নিজের অসহায়তা প্রকাশ করার অভ্যাস সর্ব ইয়োরোপীয়েরই আছে, কিন্তু এর সবচাইতে বেশি কনজাশ ফ্রান্সে–শ্যাম্পেন বা ব্র্যান্ডির চেয়েও ঢের ঢের বেশি; এসব কবিতা বোঝাবার সময় বেনওয়া সাহেব যা শোভার শ্রাগ করলেন তার থেকে আমার মনে হল যে আগামী দশ বৎসরের রেশন তিনি ওই হালের কবিদের পাল্লায় পড়ে তিন মাসেই খতম করে দিচ্ছেন। এবং ওই শ্রাগ করার সঙ্গে সঙ্গে হাতের তেলোদুটো এমনভাবে চিত করতেন যে আমরা স্পষ্ট বুঝতুম, ইংরেজিতে যাকে বলে, ঘোড়াকে জলের যথেষ্ট কাছে আনা হয়েছে, এখন সে যদি না খায়—
দ্বিতীয়ত, সনাতন লেখকদের বেলা তিনি মাঝে মাঝে আমাদের অনুবাদ করতে বলতেন। কিন্তু এই মডার্ন কবিদের হাতে নিরীহ বঙ্গসন্তানদের বে-পনাহ অর্থাৎ একান্ত অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে তিনি সাহস পেতেন না। নরখাদক না হলেও, যারা তাদের কবিতা বোঝবার চেষ্টা করে, তাদের মগজ যে কীরকম কুরে কুরে খেতে পারেন, সে তত্ত্বটি সায়েবের অজানা ছিল না। এবং ওই সময়ে শান্তিনিকেতনের একটি ছেলে পাগল হয়ে গেলে যে গুজব রটেছিল, তার বিরুদ্ধে তারস্বরে প্রতিবাদ জানিয়ে আমি আজ বলছি, সর্বৈব মিথ্যা; সে ছোকরা একদা ফরাসি ক্লাসে আসত বটে, কিন্তু ওইসব পোয়েৎ দ জ্বরদইদের প্রথম দর্শন পাওয়ামাত্রই সে বাপ্পো বাপ্পো রব ছেড়ে অধ্যাপক মিশ্রুজির পাণিনি ক্লাসে চলে যায়– যে ক্লাসটাকে আমরা বাঘের চেয়েও বেশি ভরাতাম এবং পরে মুক্তকণ্ঠে বলে, এসব হালের ফরাসিস কবিদের বোঝার চেয়ে পাণিনির সূত্র বোঝা ও কণ্ঠস্থ করা ঢের ঢের সহজ।
একে মডার্ন, তায় ফরাসিস, তদুপরি কোনও কোনও কবি পাস প্যারিসিয়ান উপস্থিত আবার বাংলা দেশে একটা বিশেষ রস বা ওই ধরনের একটা কিছু নিয়ে জোর আন্দোলন চলছে– কাজেই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগা অসম্ভব নয়, এসব কবিরা কাব্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতার মধ্যে কোনও পার্থক্য স্বীকার করতেন কি না? আমার তো শেষ প্রসা ছিল ওইটেই। এত যে মেহৎ করছি, তার ফলে আখেরে যদি এমন কিছু জুটে যায় যার প্রসাদাৎ সংস্কৃত-পড়নেওলাদের ঢিট দিতে পারি। ধ্যওর তোর চৌরপঞ্চশিকা আর কুট্টনীমত! আসল মাল এ্যাদ্দিনে, বাবা, এদেশে এসে পৌঁছেছে, নাক বরাবর প্যারিস থেকে। আয়, শুনে যা। কারণ এদের কেউ কেউ অল্পবিস্তর পাস পড়েছে, অবশ্য ইংরেজি অনুবাদে,(২) তাই (ওই বয়সে) আমার সরস আহ্বান শুনে যে আমার সামনে করজোড়ে আসন নিত সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু হায়, অধ্যাপক বেনওয়া স্বয়ং বহু বৎসর প্যারিসে কাটিয়েছিলেন বলে এ-বিষয়ে সাবধান হতে জানতেন। ক্লাসে দুটি মেয়ে ছিল বলে তিনি প্রথমদিনই বলে দিয়েছিলেন, কোন কোন কবিতা ক্লাসে পড়ানো হবে।
আমার নিজের কেমন জানি একটা অন্ধবিশ্বাস সেসময় জন্মেছিল যে অধ্যাপক বেনওয়া স্বয়ং এই নতুন একোল স্কুল বা রীতিটা পছন্দ করতেন না, বিশেষ রসও পেতেন না। তিনি আমাদের সঙ্গে মডার্ন ফ্রান্সের নবীন কাব্য-আন্দোলনের পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মাত্র অনেকটা যেন কর্তব্য পালনের জন্য।
তবু এই সুবাদে একটি তত্ত্বকথা বলে রাখা ভালো। এসব মডার্ন কবিদের সাধনা ছিল সত্যই বিস্ময়জনক। কারও কারও ছন্দহীন, লয়বিহীন, মিলবর্জিত বস্তৃত সর্ব অলঙ্কারশূন্য– এলোপাতাড়ি আবোল-তাবোল শব্দসমষ্টি দেখে যখন আমরা উদ্ভ্রান্ত তখন বেনওয়া সায়েব অপেক্ষাকৃত প্রাচীন কাব্য থেকে পড়ে শোনাতেন এদেরই আগেকার দিনের, প্রাচীন পদ্ধতিতে রচিত কবিতা– মডার্ন আন্দোলনে যোগ দেবার পূর্বে রচিত।
এবং সেগুলো শুনে, পরে পড়ে স্তম্ভিত হয়েছি। অনবদ্য এক-একটি কবিতা! কতখানি পরিশ্রম, কতখানি সাধনার প্রয়োজন এরকম অত্যুত্তম কবিতা রচনা করতে! অর্থাৎ, এরা ব্লাফ-মাস্টার নন। প্রাচীন পদ্ধতিতে কবিতা রচনা করার টেকনিক, স্কিল, কৌশল সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত করার পর এঁরা যে কোনও কারণেই হোক খুব সম্ভব নিজের সৃষ্টিতে ঈপ্সিত পরিতৃপ্তি না পেয়ে ধরেছেন অন্য টেকনি, বা বলা যেতে পারে, চেষ্টা করছেন নতুন এক টেকনিক আবিষ্কার করার। সেজানের ছবি দেখে অজ্ঞজন মনে করে, এরকম এলোপাতাড়ি তুলির বাড়ি ধাম-ধুপুস মারা তো যে কোনও পাঁচ বছরের বাচ্চাও দেখিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সেজান যখন প্রাচীন অ্যাকাডেমিক টেকনিকে আঁকতেন তখনকার ছবি দেখলে চক্ষুস্থির হয়ে যায়। তখনকার দিনের অ্যাকাডেমিক যে কোনও চিত্রকরের সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারতেন, কারণ একে তো ছিল তাঁর বিধিদও অসাধারণ সৌন্দর্যবোধ ও স্পর্শকাতরতা, তদুপরি তার আঙুলগুলো যেন শুধু ছবি আঁকার জন্যই বিধাতা নির্মাণ করেছিলেন, এবং সর্বোপরি তার বহু বৎসরব্যাপী অক্লান্ত সাধনা, ওই প্রাচীন অ্যাকাডেমিক টেকনিক্ সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ আয়ত্ত করার জন্য। এদেশে তাই যখন দেখি, মাত্র দুটি বছর রেওয়াজ- কবিতা, গান, নাচ যাই হোক না কেন–করেছে কি না, তার আগেই সে লেগে যায় কম্পোজ করতে, এবং অন্যকে বিজ্ঞভাবে নবীন পন্থা বাঙ্গাতে, তখন– থাক্ গে।