কারণ সর্বশেষে সাহেব বললেন, অতএব এই নতুন ফ্রান্সকেও ভোমাদের চেনা উচিত বিশেষ করে তার কাব্যপ্রচেষ্টাকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফ্রান্স থেকে আনালেন–তখনকার দিনে জাহাজ-রেলে প্রায় দু সপ্তাহ লাগত বেশ মোটা মোটা দু-ভলুমে সম্পূর্ণ মডার্ন কবিতার চয়নিকা। শিরোনাম, পোয়েৎ দ জুই, পোয়েটস্ অব টুডে, হালের কবি, আজকের কবি যেটা আপনার প্যারা লাগে বাংলাতে সেইটেই বেছে নিন।
বলছিলুম না, চোখের জলে নাকের জলে পড়েই যাচ্ছি, পড়েই যাচ্ছি, কোনও হদিস আর পাইনে। ক্লাসের পড়া তৈরি করতে আগে আমার লাগত তিন পো ঘন্টাটাক, এখন দু-ঘণ্টা তিন-ঘণ্টা অভিধান ঘেটেও কোনও হদিস পাইনে। একটা তুলনা দিয়ে জিনিসটা পরিষ্কার করি। আপনি কোনও বিষয়বস্তু পড়ছেন যেটা সরল, এবং লেখকের উদ্দেশ্যও সরল। সেখানে মনে করুন হঠাৎ এল একটা শব্দ যার অর্থ আপনি জানেন না, যেমন ধরুন কর। অভিধান খুলে মানে পেলেন করা ধাতুর রূপ বিশেষ, খাজনা হাত কিরণ হাতির গুড় হিন্দুর উপাধি বিশেষ। এতক্ষণ ধরে লেখকের সবকথাই আপনার কাছে পরিষ্কার ছিল বলে, পূর্বাপর প্রসঙ্গ বিবেচনা করে আপনি চট করে বুঝে গেলেন কোন অর্থটা লাগবে, লেগেও গেল ক্লিক করে। তাই বোধহয় অভিধানকে কুঞ্চিকাও বলা হয়। সেখানে আপনি পাবেন চাবি– এটা প্রয়োগ করে আপনি যে অচেনা শব্দরূপ খুলতে চান, সেটি খুলতে পারেন। এর পরে তুলনাটা হয়তো টায়-টায় মিলবে না, আমার বক্তব্য কিঞ্চিৎ খোলসা করবে। আপনার নিজের যে তালা আপনি নিত্যি নিত্যি খোলেন তার চাবি যদি হারিয়ে যায়, আর কেউ এসে একগুচ্ছ জাত-বেজাতের চাবি দেয়, তা হলে কোন চাবিটি দিয়ে আপনার তালাটি খোলা যাবে সেটা চট করে বেছে নেবেন– জোর, নিতান্ত একাকার হলে, দু-তিনটে ট্রায়েল নিয়েই কর্মসিদ্ধি।
আর এখানে, অর্থাৎ এই মডার্ন কবিতা নিয়ে হালটা কী? যেন তালাটিই দেখতে পাচ্ছিনে ভালো করে আদৌ আছে কি না সে ভি কসম খেয়ে বলতে পারব না, অর্থাৎ বিসমিল্লাতেই গয়লৎ (গলৎ)-কেমন যেন আবছা-আবছা গোছ, ওই যে সায়েব অধ্যাপক স্বয়ং বলেছিলেন কেমন যেন আধা-আলো-অন্ধকার, ফরাসিতে বলে ক্রেস্কুল (ইংরেজিতে বিশেষ্যটা চলে না বটে, কিন্তু বিশেষণটা ৫epuscular- মাঝে মাঝে পাওয়া যায়) এদেশের পরবর্তী যুগের ধূসর! এদিকে তালাটাই দেখতে পাচ্ছিনে ভালো করে, ওদিকে অভিধান আমার হাতে তুলে দিলেন চারটে চাবি এখন লাগাই কোনটা? এমনকি রাজাকে হাতির শুঁড় (কর) দিলুম অর্থও যদি রাজাকে খাজনা (কর) দিলুম এর বদলে বেরোয় তাতেও আমি খুশি। কথায় বলে হাতের একটা পাখি কানা মামার চেয়ে ভালো–ঐ যা, দুটো প্রবাদে গোবলেট করে ফেললুম নাকি? তা সঙ্গগুণে সবই হয়। অর্থাৎ সে-যুগের ফরাসি মডার্ন কবিতা শব্দ, অর্থ, অনুপ্রাস, এমনকি বানান নিয়েও, এক্ষুনি আমি যা গোবলেট পাকালুম, তার চেয়ে কোটি গুণে (ইনফিনিটি সিম্বলটি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেটি বোধহয় ছাপাখানায় নেই) ওস্তাদ ছিল– গোবলেট পাকাতে।
বেশ কয়েকদিন, গলদঘর্ম পরিশ্রম করার পর আমি স্থিরনিশ্চয় হলুম, আমার মনে সন্দেহের অবকাশ মাত্র রইল না, এ বন্ধু কাব্য নয়, এটা নিশ্চয়ই দর্শন। কারণ দর্শনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে দার্শনিকশ্রেষ্ঠ শোপেনহাওয়ার বলেছেন (আমি অনুবাদের খাতিরে একটুখানি কনসুরা লাগাচ্ছি);
দর্শন হল গিয়ে অমানিশার অন্ধকার অঙ্গনে অন্ধের অনুপস্থিত অসিত অশ্ব অণ্ডের অনুসন্ধান।
কিন্তু এ তত্ত্বে পৌঁছনোর পরও আমি অত সহজে হাল ছাড়িনি– তার জন্য বয়সটাই দায়ী; এটা জেদির বয়স।
কারণ আমার মনে পড়ল, ছেলেবেলায় কাকার কাছে শোনা একটি তত্ত্বোপদেশমূলক কাহিনী। এক রাজার ছিল একটি অতি বিরল মহামূল্যবান, সাদা হাতি। সে দিন দিন কেন শুকিয়ে যাচ্ছে তার অনুসন্ধান করার ফলে ধরা পড়ল যে, তার মাহত শত সাবধানবাণী সত্ত্বেও অতি সঙ্গোপনে হাতির দানা চুরি করছে। রাজা ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে তার প্রাণদরে হুকুম দিলেন। মাহুত যখন দেখল এ-হুঁকুম কিছুতেই রদ হবে না, রাজার সামনে নিবেদন করল, তাকে যদি এক বছরের সময় দেওয়া হয় তবে, একমাত্র তারই জানা গোপন কৌশল প্রয়োগ করে ওই সাদা হাতিটাকে দিয়ে মানুষের মতো কথা বলাতে পারবে। রাজা সম্মত হলেন। মাহুতের অন্তরঙ্গ বন্ধুরা যখন তাকে ওধাল হাতিকে দিয়ে সে কথা বলাবে কী করে, তখন সে বলল, ভাইরা সব, এক বছরের ভিতর কতকিছুই-না ঘটতে পারে। এক বছরের ভিতর রাজা মারা যেতে পারেন, কিংবা হাতি মারা যেতে পারে, কিংবা আমি মারা যেতে পারি এবং কে জানে, কিংবা হয়তো হাতিটা শেষমেশ কথাই বলে ফেলতে পারে!
আমিও সেই আশাতেই রইলুম, কে জানে এসব কবিতার মানে একদিন হয়তো বেরিয়ে গেলে যেতেও পারে। যদিও অকপট চিত্তে স্বীকার করছি, আমার তখন মনে হয়েছিল, এবং আজও মনে হয়, আচম্বিতে হাতির মানুষের মতো কথা বলতে পারাটার সম্ভাবনা এসব কবিতার অর্থ বোঝার সম্ভাবনার চেয়ে ঢের ঢের বেশি।
সত্যের অপলাপ হবে বলে স্বীকার করছি, সাহেব আমাদের বলেও ছিলেন, প্রাচীন যুগের ল্য কঁৎ দ্য লিল বা গোর কবিতার অর্থ যেরকম বর্ণে বর্ণে বোঝা যায়, এসব পোয়েৎ দ জ্বরদ্যুই- হালের কবিদের কাছ থেকে সেটা যেন প্রত্যাশা না করি- এর নাকি অনেকখানি সরাসরি, সোজাসুজি অনুভূতির যোগে চিত্তে গ্রহণ করতে হয়। কী প্রকারে সে যোগ করতে হয় সেটা অধ্যাপককে গুধিয়ে তাকে বৃথা হয়রান করতে চাইনি। কারণ যেখানে অনুভূতির কারবার সেখানে সে রসে উপনীত হওয়ার প্রক্রিয়া তো আর সিলজি দিয়ে বানোনা যায় না। যেমন মাকে কী করে ভালোবাসতে হয় এটা তো আর কাউকে ইন্সট্রাকশন দিয়ে শেখানো যায় না যেরকম বিস্কুটের টিনের উপরে ছাপা নির্দেশনানুযায়ী-প্রক্রিয়ায় টিনটি পরিপাটিরূপে খোলা যায়।