কিন্তু আমি যুবকদের কথা বলছিলুম। তাদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথের বাণীর মাধ্যমে অনুত্ব করল যে প্রচলিত খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস না করেও শাশ্বত সত্য ধর্মনিরপেক্ষ ঈশ্বরবিশ্বাসের উচ্চতম পর্যায়ে ওঠা যায়, এঁদের একাধিক জন তখন প্রাচ্যভূমিতে এসে স্থায়ী বসবাস নির্মাণ করতে উস্ত্রী হন।
এঁদেরই একজন মসিয়ো ফের্না বেনওয়া। রবীন্দ্রনাথ যে-কজন ইয়োরোপীয়কে বিশ্বভারতীতে কয়েকজনকে অন্তত সাময়িকভাবে শিক্ষাদানের জন্য আহ্বান করেছিলেন তাদের সকলেই শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন : যেমন লেভি, ভিটারনিস, দুচ্চি ইত্যাদি। খাঁটি সাহিত্যিক ছিলেন একমাত্র অধ্যাপক বেনওয়া এবং তিনি ফ্রান্সেও সুপরিচিত ছিলেন। তার প্রকৃত পরিচয় আমরা পাই, যখন মনীষী রমারল তার জীবনের ষষ্টিতম বত্সরে পদার্পণ করার শুভলগ্নে বিশ্ববাসী গুণীজ্ঞানীগণ একখানা পুস্তক তাকে উৎসর্গ করেন। বইখানার নাম তারা দেন লাতিনে লিবার আমিকরু- অর্থাৎ সখাগণপ্রদত্ত (উৎসর্গিত) পুস্তক। এদেশ থেকে লেখেন মহাত্মা গান্ধী, জগদীশচন্দ্র বসু ইত্যাদি। পৃথিবীর প্রায় সর্ব সভ্যদেশ থেকে কেউ-না-কেউ ওই শুভলগ্নে রাকে অভিনন্দন জানিয়ে তার সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখেন। আমার এখনও মনে আছে এক আরব রলাঁকে উদ্দেশ করে লিখেছিলেন, তুমি লৌহসম্মার্জনী দ্বারা ইয়োরোপের কুসংস্কার জঞ্জাল দূর করেছ। বলা বাহুল্য, এই লেখনী সঞ্চয়নে আপন রচনা দিয়ে শ্লাঘাপ্রাপ্তির জন্য যখন সর্ববিশ্বের সহস্র সহস্র গুণীজ্ঞানী উগ্রীব, তখন প্যারিস থেকে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানানো হয় অধ্যাপক বেনওয়াকে, তার রচনার জন্য। তিনি তার স্বাভাবিক বিনয়শত আশ্রমের কাউকে কিছু বলেননি, কিন্তু ওই লিবার আমি যখন আমাদের লাইব্রেরিতে পৌঁছল তখন আমরা সেটিতে আমাদেরই অধ্যাপকের রচনা দেখে বিস্মিত ও আনন্দিত হই। তিনিও আবার তার প্রবন্ধে কোনও গুরুগম্ভীর বিষয়ের অবতারণা করেননি আমরা ঠিক সেই সময়ে তার ক্লাসে রলর এক স্বল্পখ্যাত পুস্তিকা পিয়ের এ লস- পিটার ও লসি পড়ছিলাম। চটি বই। বিরাট জা ক্রিস্তফ লেখার পর রল দুই তরুণ-তরুণীর একটি বিশুদ্ধ প্রেমের কাহিনী লিখে জা ক্রিরে মতো বিরাট পুস্তকের কঠিন কঠিন সমস্যা, ইয়োরোপীয় সভ্যতা নিয়ে আলোড়ন-বিলোড়ন থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছিলেন। বেনওয়া তাঁর প্রবন্ধ লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনে পিয়ের এ লাস–যতদূর মনে পড়ছে, এই শিরোনামা দিয়ে, এবং পিয়ের এ স পড়ে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীর মনে কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তার সবিস্তার বর্ণনা দেন। রলাকে উৎসর্গিত লিবার আমিকম্পু স্তকের কোনও কোনও অংশ সেসময়ে কালিদাস নাগ অনুবাদ করে এদেশে প্রকাশ করেন।
অধ্যাপক বেনওয়ার গত হওয়ার দিবস বিস্ময়সূচক। যে গুরুর কাছ থেকে তিনি অকৃপণ স্নেহ ও সম্মান পেয়েছিলেন তারই জন্মশতবার্ষিকীর দিনে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
এস্থলে আমি অধ্যাপক বেনওয়ার জীবনী লিখতে যাচ্ছিনে। বস্তুত ১৯২১ থেকে এবং সঠিক বলতে গেলে যবে থেকে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন সেই সময় থেকে ১৯৪১ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত যেসব গুণীজ্ঞানীরা এখানে অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করেছিলেন তাদের পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখার ভার আমার স্কন্ধে নয়। কার, সেটা বলা বাহুল্য। বছর দশেক পূর্বে লাইপসিক বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রভবনকে লেখে, তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রদের জীবনী প্রকাশ করছেন, জনৈক মার্ক কলিন্স সম্বন্ধে শান্তিনিকেতনের কেউ কিছু জানে কি না? (কলিন্স এখানে অধ্যাপনা করেছিলেন। অন্যরা তাদের ছাত্রদের সম্বন্ধে লেখে আর আমরা আমাদের অধ্যাপকদের বৃথা বাক্য থাক! (স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেছেন।)(১)
সেই বেনওয়া সাহেব কয়েকদিন ফরাসি ক্লাস নেওয়ার পর বললেন, তোমরা যে মলিয়ের, ফ্লবের, যুগো (Hugo), জিদ, ফ্রাস পড়তে চাও সে তো খুব ভালো কথা। কারণ আজকালকার ইয়োরোপীয় ছাত্রছাত্রীদের এসব লেখকের বই পড়ানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা লাতিন-গ্রিক তো শিখতেই চায় না, তার অনুবাদেও বিরাগ, এমনকি এই একটু আগে যাদের নাম করলুম, তাদের লেখার প্রতিও কোনও উৎসাহ নেই, তাদের কারণ তারা লেখেন ক্লাসিকাল পদ্ধতিতে। তার অন্যতম মূল সূত্র যে জিনিস স্বচ্ছ (ক্লিয়ার, পরিষ্কার যার অর্থ অতি সহজেই বোঝা যায়) নয়, সে জিনিস ফরাসি নয় (সূ কি নে পা ক্ল্যার নে পা ফ্রাসে!) আর এ-যুগের পাঠকরা চায় আধা-আলো-অন্ধকার। তাদের বক্তব্য, তোমরা জীবনটাকে যতখানি সহজ সরল স্বচ্ছ ধরে নিয়েছ এবং ফলে স্বচ্ছ সরল পদ্ধতিতে প্রকাশ করো জীবনটাকে বাস্তবে সে তা নয়, জীবন ওরকম হয় না। সর্ব মানবজীবনেই আছে আলো-আঁধারের দ্বন্দ্ব তাই তার প্রকাশও পরিষ্কার হয়ে ধরা দেবে না। আমরা আজ যা লিখছি সেটা পুরনো স্টাইলকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছে, এবং তোমরা যারা প্রাচীন পদ্ধতিতে অভ্যও তারা তো এটাকে দুর্বোধ, অবোধ্য এমনকি অর্থহীন প্রলাপ বললেও বলতে পারো, কিন্তু আমরা তার কোনওই পরোয়া করিনে। আমরা আমাদের অপক্ষে এগিয়ে যাব, এবং এই করেই নতুন পথ বানাব।
এতদিন পরে কী আর সবকথা মনে থাকে! এটা হচ্ছে ১৯২১/২২/২৩-এর কাহিনী। তখনও এদেশে মডার্ন কবিতা জন্ম নেয়নি, (পরবর্তী যুগে যখন নিল, তখন হিসাব নিয়ে দেখা গেল, এসব মডার্ন কবিতাতে যে শব্দটি বার বার, এমনকি বলা যায় সর্বাধিকবার আসে সেটি ধূসর। তখন মনে পড়ল, ফ্রান্সের মডার্নদের সম্বন্ধে অধ্যাপক বেনওয়ার প্রাচীন দিনের বিবৃতি সেখানে মূল কথা ছিল অস্পষ্ট দ্বমুখর এবং সর্বোপরি আধা-আলো-অন্ধকার। সেই বস্তুই এদেশে এসে পরেছে ধূসর আলখাল্লা! তা হবেই-না কেন? এদেশটা তো বৈরাগ্যের গেরুয়া বসনধারী, আর গেরুয়া যা ধূসরও তা!) তবে মোটামুটি যা বলেছিলেন, সেটা মনে আছে এবং চোখের জলে নাকের জলে মনে আছে?