আমাদের চিহ্ন দেখাতে পারি–অর্থাৎ আল্লাতালা স্বয়ং তাঁকে সত্যধর্মের গভীর তত্ত্বে দীক্ষিত করবেন– পূর্বোক্ত নজাৎ মোক্ষ ইত্যাদি।
এস্থলে প্রশ্ন, মসজিদ-উল-আকসা কোন স্থলে অধিষ্ঠিত মুসলিম-অমুসলিম (অমুসলিম এই কারণে বলছি, প্রচলিতাৰ্থে অহিন্দু মাক্সমুলার যেরকম বেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন, ঠিক সেই জিনিসই করেছেন একাধিক ইয়োরোপীয় অমুসলিম পণ্ডিত কুরান-হদিস নিয়ে) সকলেই তার অধিষ্ঠান জেরুজালেমে ছিল বলে স্থিরনিশ্চয়– তাই আমি অনুবাদ এবং টীকাতে একই রাত্রে মক্কা থেকে জেরুজালেম ভ্রমণের কথা বলছি।
পণ্ডিতদের বক্তব্য, মক্কা শরিফের বাইরে এমন এক জায়গা যেটি আল্লা স্বয়ং পূতপবিত্র করেছেন, সে শুধু জেরুজালেমই হতে পারে। কারণ ইসলামের প্রথম অ্যুদয়ের সময়ই হজরত ওইদিকে মুখ করে নামাজ পড়েছিলেন। অতএব সেই জেরুজালেমের সলমনের মন্দিরের সঙ্গে সংযুক্ত ভূমিতেই আছে মসজিদ-উল্-আক্সা।
পূর্বেই বলেছি খলিফা ওমর সলমন মন্দিরের সেই ভগ্নস্তূপ পরিষ্কার করে নির্মাণ করেন একটি মসজিদ এবং পরবর্তীকালে আব্দুল মালিক নির্মাণ করেন ডোম অব দি রক এবং তারই অতি কাছে আরেকটি বৃহত্তম বিরাট মসজি-উ-আক্সা।
ডোম অব দি রক একটা পাথরের চতুর্দিকে গড়া হয়েছিল বলে স্থপতি সেটাকে হাজার হাজার নমাজার্থী মুসলমানের জন্য বিরাট কলেবর দিতে পারেননি। তাই তিনি সেটিকে করেছিলেন সুন্দর, মধুর। অবশ্য মসজিদের চতুর্দিকে দিয়েছিলেন প্রশস্ততম অঙ্গন (এদেশের মন্দিরে সঙ্কীর্ণ গর্ভগৃহের চতুর্দিকে যেরকম বিস্তীর্ণ অঙ্গন রাখা হয়, কিন্তু গ্রীষ্মকালে, জেরুজালেমের দ্বিপ্রহর রৌদ্রে সেখানকার অনাচ্ছাদিত মুক্তাঙ্গনে– যেখানে মস্তকোপরি সূর্যের প্রতাপের চেয়ে পদতলের পাষাণ ঢের বেশি পীড়াদায়ক– সেখানে জুম্মা নামাজ পড়া অহেতুক পীড়াদায়ক হবে বলে তিনি নির্মাণ করেছিলেন, তার প্রাণ যা চায় সেই পরিমাণে বিস্তৃত, মসজিদ-উল্-আকসা।
কিন্তু এহ বাহ্য।
আসলে বিশ্ব মুসলিমের কাছে মসজি-উ-আসা তাবৎ পুণ্যভূমির মধ্যে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর।
কুরান হদিসের সঙ্গে যে মুসলিমের সামান্যতম পরিচয় আছে, সে-ই আপন মনে কল্পনা করে, সেই সুদূর মক্কা থেকে আল্লা তার প্রিয় নবীকে রাতারাতি নিয়ে এলেন মসজি-উ আসাতে (শব্দার্থে মক্কা থেকে সবচেয়ে দূরে পুণ্যক্ষেত্রে), সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল, বুর নামক পক্ষিরাজ অশ্ব এবং তার মুখ মানবীর ন্যায় সেই অশ্বে সোয়ার হয়ে নবীজি পৌঁছলেন বেহেশতের দ্বারপ্রান্তে।
এই নিয়ে সে মনে মনে কত না কল্পনার জাল বোনে! স্বয়ং আল্লার সঙ্গে সশরীরে সাক্ষাৎ!
অবশ্য একথাও সত্য যে, বহু মুসলিম দার্শনিক সুফি (রহস্যবাদী ভক্ত = মিষ্টিক) এ প্রশ্ন বার বার শুধিয়েছেন, এই যে হজরতের স্বর্গারোহণ এটা বাস্তব না স্বপ্ন; তিনি কি সশরীরে স্বর্গে গিয়েছিলেন, না তাঁর আত্মা মাত্রই আল্লার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু মোলাকাত যে হয়েছিল সে সম্বন্ধে সবাই নিঃসন্দেহ।
যাই হোক, যা-ই থাক, এই মসজিদ-উল্-আক্সা থেকেই, আল্লাতালা হজরতকে দিয়ে স্থাপন করলেন মর্তভূমি ও স্বর্গভূমিতে যোগ-সেতু।
সেই সেতুর পার্থিব প্রান্ত পুড়িয়ে দিয়ে সে সেতু বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা অজ্ঞ-বিজ্ঞ যে কোনও মুসলমানকেই বিচলিত করার কথা।
———–
১. কুরান শরিফে জিব্রাইলের উল্লেখ নেই। একাধিক হদিসে সবিস্তর আছে।
আধুনিকের আত্মহত্যা
১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দের কথা। ১৯১৪-১৮ বিশ্বযুদ্ধে যত যুবক ইয়োরাপের ভবিষ্যৎ খ্রিস্টধর্মের ব্যর্থতা এবং স্ব স্ব আদর্শবাদ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, কেন জানিনে, তার দশমাংশও করেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথ যখন ইয়োরোপের ভিন্ন ভিন্ন নগর, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও ভারতের শাশ্বত বাণী প্রচার করে বক্তৃতা দেন তখন বিশেষ করে মুগ্ধ হন তারাই, যারা একদা খ্রিস্টধর্মে গভীর বিশ্বাস ধরতেন কিন্তু যুদ্ধের কল্পনাতীত বর্বরতা দেখে সে ধর্মের কার্যকারিতা অর্থাৎ খ্রিস্টধর্ম ইয়োরোপের খ্রিস্টানগণকে দ্ৰমানুষে পরিবর্তিত করতে পারবে কি না, সে-বিষয়ে অত্যন্ত সন্দিহান হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকেই নৈরাশ্যবশত সাতিশয় বিরক্তিসহ চার্চে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি তাদের ঈশ্বরবিশ্বাসের দৃঢ়ভূমি পর্যন্ত যেন তাদের পায়ের তলা থেকে ক্রমেই শিথিল হয়ে সরে যাচ্ছিল। শুধু যুবক সম্প্রদায়ই নয়, অপেক্ষাকৃত বয়স্ক গুণীজ্ঞানী পণ্ডিতরা পর্যন্ত ইয়োরোপের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন ভিক্টোরীয় যুগে তাদের যে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মনুষ্যজাতি, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গগণ সভ্য থেকে সভ্যতর পর্যায়ে উঠছে এবং ফলে একদিন আর এ-সংসারে দুঃখদৈন্য অনাচার-উৎপীড়ন থাকবে না, সেটি লোপ পেল। বিশেষ করে যারা ইতিহাসের দর্শন নিয়ে হেগেলের যুগ থেকে প্রশ্ন করছেন যে, ইতিহাসে আমরা শুধু অসংলগ্ন, চৈতন্যহীন মূঢ় কতকগুলি ঘটনা-সমষ্টি পাই, না এর পিছনে কোনও সচেতন সত্তা ঘটনাপরম্পরাগত ক্রমবিকাশের মাধ্যমে শুধু যে মানুষকে উন্নততর এবং সভ্যতর পন্থায় নিয়ে যাচ্ছে তাই নয়, নিজেকেও সপ্রকাশ করছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকেই দ্বিতীয় সমাধানটি অগ্রাহ্য করলেন, এবং অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ ইতিহাস-দর্শনের সুপণ্ডিত অসন্ট স্পেঙলার তাই লিখলেন, য়ুরোপের সূর্যাস্ত (ড্যার উন্টেরগাঙ ডেস্ আবেন্টলাভের)। বইখানার খ্যাতি সে যুগে পঞ্চমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।