শ্ৰেষ্ঠতার আরাধনাই মানুষের কর্তব্য, নিকৃষ্টতার পূজা নয়। আর শ্রেষ্ঠতার আরাধনার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় প্রকৃত অনুরাগ। অনুরাগই কঠিন ব্যাপারকে সহজ করে তোলে, পকে গিরি লঙ্ঘন করায়। শ্রেষ্ঠ বৃত্তিসমূহকে ভালোবাসলেই নিকৃষ্ট বৃত্তিসমূহের দাবি কমে আসে, নইলে তাদের জুলুমের অন্ত থাকে না। বড়কিছুকে ভালো না বাসলে ছোটকিছুর অত্যাচারে জীবন জীর্ণ হয়ে আসে, ভালোবাসাকে বড় না জানলে ঘৃণা-বিদ্বেষের জয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। যোগ্যতমের উদ্বর্তন নীতি প্রয়োজনের ভাওতায় বড় জিনিসকে ছোট, আর ছোট জিনিসকে বড় করে তুলে মানুষের অশেষ অকল্যাণ করে। সৌন্দর্য ও আনন্দের ওপর জোর না দিয়ে টিকে থাকার প্রবৃত্তির ওপর জোর দেয় বলে তা জীবনের কদর্য ক্ষুধাকেই বড় করে তোলে। সুতরাং’আগে টিকে থাকা পরে সৌন্দর্য এই নীতির প্রশ্রয় না দেওয়াই ভালো। কেননা, তাতে শালীনতার ও শোভনতার দাবি নিচে পড়ে যায়, আর বর্বর অধিকার বৃত্তি লেলিহান জিহ্বা মেলে ধেই ধেই নৃত্য করতে থাকে। তাকে সংযত করতে পারে সৌন্দর্যপ্রেম, অন্য কিছু নয়। নীতির শাসন এখানে ব্যর্থ। যোগ্যতমের উদ্বর্তন নীতি মানুষকে ইতরতা থেকে মুক্ত হতে দেয় না, ছোটখাটো স্বার্থের নিগড়ে বেঁধে রেখে তাকে নীচনা করে গড়ে তোলে। ছোট ভাব সবসময়ই বড় ভাবকে ব্যর্থ করেছে ও করবে। অতএব, বড় ভাবের প্রতি বিশেষ অনুরাগ না থাকলে তার কোনো ভরসা থাকে না। সত্যের জয় হবেই একথা ভুল; জয় হোক না হোক, সত্যের জন্য প্রাণপাত করা উচিত, এ-কথাই ঠিক। মিথ্যা আশায় সত্যের জয় কমে আসে– পরাজয়ের লক্ষণ দেখলে মন দ্বিধান্বিত হয়।
দর্শন সম্বন্ধে ওপরে যা বলা হয়েছে তার আর-একটি নজির সম্প্রতি আমার চোখে পড়েছে। দার্শনিক যখন বলেন, মানুষের বিকাশের পশ্চাতে অর্থনীতিই প্রধান, তখন তিনি সাধারণ সত্যই প্রচার করেন, কিন্তু দর্শনের সমর্থনে এই সাধারণ সত্যই মহামূল্য হয়ে দেখা দেয় এবং একে অতিক্রম করার শক্তি-যে ব্যক্তিমানুষের আছে, মানুষ তা ভুলে যায়। ফলে মানুষের ইচ্ছাশক্তি সঙ্কুচিত হয়ে আসে–মানুষ মহৎ ও সুন্দর জীবনের দায়িত্ব অস্বীকারের পথ খুঁজে পায় এবং অপরের মহত্ত্ব ও সৌন্দর্যকে ছোট করে দেবার সুযোগ লাভ করে। এতে তার ক্ষতি হয় বিস্তর বাস্তব-উত্তীর্ণ হওয়ার আত্মিক শক্তি থেকে বঞ্চিত হয় বলে তার স্বাধীনসত্তা কিছুই থাকে না, সে অবস্থার দাসমাত্র হয়ে পড়ে। একপ্রকারের নিরুদ্বেগ জীবন সে লাভ করে বটে, কিন্তু এই নিরুদ্বেগতা নিষ্প্রাণতার নামান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। মনের কান্না তার থেমে যায়, আর এই মনের কান্নাই-যে মহৎ সৃষ্টির প্রেরণা, তা সে উপলব্ধি করতে পারে না। অথবা মনের কান্নাও থামে না, তার উদ্দেশ্যই শুধু পরিবর্তিত হয়–অর্থ সৌন্দর্য ও আনন্দের স্থান দখল করে বসে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার ভিতরে কী একটা শক্তির অপমৃত্যু ঘটে। এই শক্তি আর কিছুই নয়, সৌন্দর্য ও আনন্দের ক্ষুধা। এর অবসানের সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক শক্তি রহিত হয়ে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়।
সৃষ্টির গোড়ায় বুভুক্ষা বা বেদনা। বেদনার ফলেই অসম্ভব সম্ভব হয়। দার্শনিকের শিক্ষার ফলে কী করে এই বেদনার মৃত্যু হয়; ইদানীং তার একটি প্রমাণ পেয়েছি। আমার তরুণ বয়সে জনৈক কিশোর বয়স্ক ছাত্রকে আমার খুব ভালো লাগত। তিনি মাঝে মাঝে মুসলমানসমাজের মানসিক দীনতা সম্বন্ধে দুঃখ প্রকাশ করতেন, আর যারা সেকালে এই দৈন্য দূর করার আন্তরিক চেষ্টা করছিলেন, তাদের প্রশংসা করতেন। তার মুখে কবি-সাহিত্যিকদের কথাই ছিল, রাজনীতিকদের কথা নয়। তিনি বলতেন, রাজনীতিকরা অধিকার আদায় করেন বটে, কিন্তু সুন্দর ও আনন্দিত জীবনের প্রেরণা দেন কবি-সাহিত্যিকরা; তাই তারা সমাজের প্রকৃত স্রষ্টা, মানুষের অন্তরে তাদেরই সিংহাসন। তবে মাঝে মাঝে যে রাজনীতিকরা বড় হয়ে ওঠেন, তার কারণ সমাজের রুগ্ণ অবস্থা; পীড়িতের কাছে ডাক্তারই বড়, বন্ধু নয়। কিন্তু সুস্থ অবস্থায় এর বিপরীতটাই ঠিক। আধুনিককালে যে রাজনীতিকরা পৃথিবীতে বড় স্থান লাভ করেছেন, তার কারণ পৃথিবীর পীড়িত অবস্থা। এক হিসাবে দেখতে গেলে সমাজের অভ্যন্তরীণ বিকাশের বাহ্যিক প্রকাশ বলে রাজনৈতিক আন্দোলন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার-সমাজ যে সুস্থ ও প্রকৃতিস্থ নয়, তারই লক্ষণ। কিন্তু বন্ধুদের ছেড়ে যে রোগী ডাক্তারকেই বড় করে তোলেন, বুঝতে হবে তিনি চিররোগী। তার মুক্তির উপায় স্বল্পই। চিররোগ প্রায়ই মানসিক ব্যাধি। অতএব, বন্ধুবান্ধবের প্রীতিকর সঙ্গই তা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়–বোতল বোতল ঔষধ সেবনে ফায়দা পাওয়া কঠিন। যে জাতি বা সমাজ কবি-সাহিত্যিক ও সৌন্দর্যশিল্পীদের অবজ্ঞা করে কেবল রাজনীতিকদের বড় করে দেখে, চিররোগীর ন্যায় তারও মুক্তি সুদূরপরাহত।*[*রুগণ অবস্থায় মানুষের কুপথ্যে রুচি হয়; প্রবল রাজনৈতিক আন্দোলনের যুগেওকুপ্রবৃত্তি বড় হয়ে ওঠে। তাই সামাজিক সমর্থন লাভ করে নিষ্ঠুরভাকে নগ্নমূর্তিতে রাজপথে বের হতে দেখা যায়।]
রাজনীতিজ্ঞের প্রিয় হওয়ার একটি কারণ, মানুষের ঝগড়াটে মনোবৃত্তি। মানুষ স্বভাবতই কোন্দলপ্রিয় রাজনীতি কোন্দলপ্রিয়তার খোরাক যোগায়। ব্যক্তির প্রতি ঈর্ষা সমাজ সহ্য করে না, চোখ রাঙিয়ে তা দমাতে চায়কিন্তু বিজাতির প্রতি ঈর্ষায় সমাজের বাহবা পাওয়া। ব্যক্তির প্রতি গালাগালি পাপ, বর্বরতা; কিন্তু বিজাতির নিন্দা পরম শ্লাঘার ব্যাপার। রাজনীতি এই ঈর্ষা ও নিন্দার পথ খোলাসা করে দেয় বলে মানুষের জীবনে তার এত প্রভাব। মানুষ মনুষ্যত্বের বড়াই করে বটে, কিন্তু আসলে তার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেলেই বেঁচে যায়। যুদ্ধের উন্মাদনা এই মুক্তির সুযোগ হয়ে দেখা দেয়, তাই যুদ্ধের নামে ছেলে বুড়ো সকলেরই উল্লাস। রাজনীতিও একপ্রকারের যুদ্ধ-স্নায়ুর সংগ্রাম। তাই মানুষের কাছে যুদ্ধের মতো রাজনীতিরও আদর। সাধারণ অবস্থায় মানুষের গায়ে কাদা কি থুতু দেওয়া যায় না। কিন্তু প্রবল রাজনীতির যুগে তা সহজেই করা যায়। রাজনীতির যুগে অসুবিধা হয় শুধু চিন্তাশীলদের। মোটা সুরের সঙ্গে মিহি সুর মেলাতে পারেন না বলে তাদের অস্বস্তির অন্ত থাকে না। লম্বা লোকেরা হাঁটু ও কোমর ভেঙে বেঁটে হওয়ার চেষ্টা করে শুধু দুঃখই পান। রাজনীতির অশ্লীলতা ও উচ্ছলতা দূর করার একমাত্র উপায় রাজনীতিকে জীবনের সারবস্তু মনে না করে মাত্র বেঁচে থাকার উপায় বলে মনে করা। তা হলেও শাশ্বত নীতির চরণে মাথা ঠেকিয়ে তা সুন্দর ও সংযত হতে পারবে। নতুবা তার কদর্যতার অন্ত থাকবে না। সংসার-ধর্ম সকলেরই পালন করতে হয় এবং করা উচিত; কিন্তু একটা উঁচু লক্ষ্যের দিকে নজর না রাখলে সংসার হয়ে পড়ে একটা কারাগার-বদ্ধকূপের জলের মতো তা মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটায়।