বিজয় চলে যায়, চৈতালীকে দিয়ে যায় চৈতালীর শ্রেষ্ঠ সময়। চৈতালীর আর জিজ্ঞেস করা হয়নি, ফেসবুকে সেক্সবয় নামের আড়ালে বিজয়ের চরিত্র কেন তার ফেসবুকে বাইরের চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত? জিজ্ঞেস করেনি, অনুমান করে নিয়েছে, মায়ের মৃত্যুর কারণে যে ভীষণ গ্লানি আর শোকে ভুগছে বিজয়, তা থেকে মুক্তি পেতেই আশ্রয় নিয়েছে ফেসবুকে, ভিন্ন চরিত্রে। চৈতালী কেন আশ্রয় নিয়েছে ফেসবুকে! তার তো কোনও গ্লানি নেই, শোক নেই! কিছু হয়তো চৈতালীর ভেতরেও আছে, চৈতালী জানে না। বিজয় জানে কি? জিজ্ঞেস করা হয়নি বিজয় জানে কিনা। এ কদিনে একবা রও চৈতালীর শরীরে বান ডাকেনি। শুধু মনেই ঝরেছে ঝড়বৃষ্টি। চৈতালীর ফেসবুকের চরিত্রটা কি চৈতালীর সত্যিকারের চরিত্র নয়! চৈতালী ভাবে, কোন বিজয়টা সত্যিকা রের বিজয়! যে বিজয়ের সঙ্গে নেটে দেখা হয়, নাকি যে রক্তমাংসের বিজয়ের সঙ্গে কলকাতায় দেখা হল! রক্তমাংসের বিজয়ই তো ফেসবুকের সেক্সবয়, যার সঙ্গে রাতে রাতে তার শরীরের উৎসব হয়। কত যে রহস্য একজন মানুষের ভেতর! সম্ভবত কয়ে কজন মানুষ একসঙ্গে বাস করে একজন মানুষের মধ্যে। একজন আরেকজনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। একসঙ্গে কি সেই কয়েকজনকে পাওয়া সম্ভব নয়! নাকি একজনকে পেতে গেলে বাকিদের হারাতে হয়! চৈতালী চৈতালীরই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করে। সংবাদপত্রে চাকরি করা চৈতালী, মা চৈতালী, মেয়ে চৈতালী, ফেসবুকের চৈতালী, আর শকুন্তলার সঙ্গে কথা বলা চৈতালী — কোনওটার সঙ্গে মিল নেই কোনওটার। কিন্তু এক চৈতালী সামনে এলে আরেক চৈতালীকে কেন পিছু হটতে হবে। মানুষ কি তবে কোনও একজনের একটির বেশি চরিত্র ধারণ করতে পারেনা, এবং তাই নিজের একটি চরিত্রকেই পরিবেশন করে অন্যের সামনে! একসঙ্গে অনেকগুলো চরিত্র অন্যের সামনে উপস্থিত করলে কার অসুবিধে, সংস্কারের, সমাজের, নাকি নিজেদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আশঙ্কার, প্রত্যাখাত হওয়ার আশঙ্কার। এসবই ভাবছিল চৈতালী যখন বিজয়কে এয়ারপোর্টেসি অফ করে বাড়ি ফিরছিল। উদাস তাকিয়ে ছিল গাড়ির জানালায়, তখন এসএমএস আসে।
বিজয় লিখেছে, আই লাভ ইউ।
বুক কাঁপে চৈতালীর। তীব্র ভালো লাগা মন থেকে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। চৈতালী লিখলো, মি টু।
ঘরে ফিরে দেখে সেই যে কণিকার সিডিটা বাজছিল, সেটা বেজেই চলেছে, কণিকার কণ্ঠে তখন, চিরসখা হে ছেড়ো না মোরে…
সঙ্গে সঙ্গে গায় চৈতালী, চিরসখা হে ছেড়ো না মোরে…
হুমায়ূন আহমেদ : পুরুষতন্ত্রের সম্রাট
হুমায়ূন আহমেদের যে ক্যানসারটি হয়েছিল, সেই একই ক্যানসার আমার মায়ের হয়েছিল। আমার মা মারা যান সাতান্ন বছর বয়সে, হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন তাঁর চৌষট্টি বছর বয়সে। এক দশকের বেশি হল আমার মা মারা গেছেন, আর এই সেদিন মারা গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। আমার মা নামি দামি কেউ ছিলেন না, সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের ভয়ংকর জন প্রিয় লেখক। হুমায়ূন আহমেদএর মারা যাওয়ার খবর শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি, কষ্ট পেয়েছি। মার কথা মনে পড়েছে, একই রকম অসুখে তিনিও ভুগেছিলেন।
নাহ, নিউইয়র্কের স্লোন কেটেরিং বা বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসা করার সামর্থ আর সুযোগ কোনওটাই আমার মার ছিল না। একরকম বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা গেছেন। আমার মা দেশের লক্ষ লক্ষ দুর্ভাগা মায়ের মত এক মা। অসুখের শেষ অবস্থায় যাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়, যখন তাদের বাঁচাবার আর সময় থাকে না, আমার মা তেমন এক মা। কোলন ক্যানসার বড় হয়ে হয়ে খাদ্যনালী বন্ধ করে ফেললে অথবা লিভারে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে গিয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা করলে কেউ হয়তো তাদের দয়া করে হাসপাতালে নিয়ে যায়, তার আগে নয়।
যতদিন বেঁচে থাকি আমার মার জন্য আমি কাঁদব, আরও শত শত মার জন্য কাঁদবো, চিকিৎসার অভাবে যারা মৃত্যুকে বরণ করতে বাধ্য হয়। কাঁদবো দারিদ্র আর। পরাধীনতার শেকলে বন্দি বাংলার সহস্র মার জন্য। কাঁদবো সেই লক্ষ কোটি অসহায় মানুষের জন্য, প্রচুর প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও শুধু মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে যাদের অন্ধকারে পড়ে থাকতে হয়, যাদের কোনও স্বপ্নই সফল হতে দেওয়া হয়না।
হুমায়ূন আহমেদকে ভুগতে হয়নি, কারণ তিনি পুরুষ। তাঁকে হাঁটতে হয়নি কোনও অমসৃণ পথে, যে পথে প্রতিটি মেয়েকেই হাঁটতে হয়। হুমায়ূন আহমেদের জন্য সম্ভ বত আমার কষ্ট হবে না দীর্ঘদিন। কারণ হুমায়ূন আহমেদ জীবনে যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন, যা ইচ্ছে করেছেন, তাই করেছেন। রাজা হতে চেয়েছেন, রাজা হয়েছেন। বাদশাহী উপভোগ করতে চেয়েছেন, উপভোগ করেছেন। পৃথিবীর খুব কম মানুষই জীবনে এত ভোগ বিলাস করার সুযোগ পান। খুব কম মানুষই নিজের যাবতীয় স্ব প্নকে সফল করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এই জীবনে কে কার চেয়ে বেশি যশ আর খ্যাতি লাভ করতে পারে, তার একটা ভীষণ প্রতিযোগিতা চলে। হুমায়ূন আহমেদ সেই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশে যারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত, তাদের হাজার মাইল পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে ছিলেন। তার নাগাল কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর মতো সৌভাগ্যবান মানুষ আমার জীবনে আমি আর দেখিনি। তিনি চলে গেছেন। এরকম সবাই যাবে, কেউ দুটো বছর আগে যাবে, কেউ দুটো বছর পরে। এই সম্ভাবনা আমার মনে হয় না খুব বেশি ছিল যে বেঁচে থাকলে তিনি নতুন ধরনের কোনো লেখা লিখতেন বা সাহিত্য জগতকে বিশাল কিছু দান করতেন। আমরা মানুষটিকে হারিয়েছি, এটাই যা ক্ষতি, তাঁর চলে যাওয়ায় সত্যি বলতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতের কোনও ক্ষতি হয়নি।