কিন্তু আশ্চর্য, দুজনের কথপোকথনে যৌনতার তিল মাত্র কিছু নেই।
— একটু জল খাবো।
–আই অ্যাম সরি। জল আগেই দেওয়া উচিত ছিল। চা বা কফি কিছু খাবে?
–না। আমি খাইনা ওসব।
–তবে কি, হুইস্কি খাবে?
— হুইস্কি তো আমি খাই-ই না।
–ও। কটার সময় রাতের খাবার খাও?
— ঠিক নেই। বেশ সুন্দর সাজানো ঘর। এত বই কার? সব তোমার?
— হ্যাঁ আমার।
বিজয় উঠে বইয়ের তাকগুলোর দিকে যায়, মগ্ন হয়ে বই দেখতে থাকে। অনে কক্ষণ কেটে যায় এভাবে। চৈতালী জল এনে দিলে বই দেখতে দেখতেই জল খায়।
–ইফ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড, আমি কি কিছু বই বের করতে পারি এখান থেকে?
–হ্যাঁ নিশ্চয়ই, গো এহেড।
বিজয় তিনটে বই নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। সোফায় এসে বললো, তুমিও দেখছি রডি ডয়েলের বই পছন্দ করো। দ্য ডেড রিপাবলিক পড়েছো?
চৈতালী হেসে বললো, ওর শুধু তিনটে পড়েছি, প্যাডি ক্লার্ক হাহাহা, এ স্টার কল্ড হেনরি আর দ্য গাটস।
–তোমার অসাধারণ কালেকশন।
— ক্লাসিকস বেশ কিছু আছে।
— ক্লাসিকসের কথা বাদ দাও। ওগুলো ছোটবেলায় পড়েছি। ইদানীং বিল ব্রাই সন থাকলে আমার আর কিছু চাই না।
— আছে বিল ব্রাইসন বেশ কটা।
চোখে মুখে খুশি লাফায় বিজয়ের।
— তুমি বিল ব্রাইসনও পছন্দ করো? বাহ! কোনগুলো আছে বলো না। শেষটা এখনও পড়িনি।
— আমার সবচেয়ে পছন্দ এ সর্ট হিস্টরি অব নিয়ারলি এভরিথি।
– ও বইটার তুলনা হয় না।
— আমার কাছে আছে আই অ্যাম এ স্ট্রেঞ্জার হেয়ার মাইসেল্ফ, অ্যাট হোম, নাইদার হেয়ার নর দেয়ার..
— ওয়ান সামারটা তো এখনও বেরোয়নি বোধহয়।
–এই অক্টোবরে বেরোবে।
বিজয়ের মধ্যে একটা কিশোর বাস করে। দেখে ভালো লাগেচৈতালীর। চৈতালীর। মতোই সে উজ্জ্বল উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সময় সময়। বইয়ের গল্পে মেতে ওঠে বিজয়। যেন দুজনে কোনও বুক ক্লাবের মেম্বার। বইয়ের পছন্দে এত মিল আর কারও সঙ্গে নেই চৈতালীর। তারপর কথায় কথায় বেড়ানোর কথা উঠলো, ভারতের কোথায় কোথায় কে গেছে। তাতেও মিল, দুজনে বর্ণনা করতে থাকে দুজনের অভিজ্ঞতা, কোথায় কোন পাহাড়ে, কোন জল প্রপাতের ধারে, কোন জঙ্গলের কোনখানটায় মুগ্ধ দাঁড়িয়েছিল কবে। একসময় খাবারের প্রসঙ্গ ওঠে, ওতেও মিল। দুজনই বাঙালি খাবার পছন্দ করে।
দশটা বেজে যায় গল্প করতে করতে। জল ছাড়া কেউ আর কিছু পান করে না। ফলের রসও, বিজয় বলেছে, খাবে না। শকুন্তলাকে ডাকে চৈতালী। শকুন্তলা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেয়। না, মোমবাতি জ্বালানোর প্রয়োজন মনে করে না চৈতালী। খেতে খেতে বিজয় বলে, বাহ, বেশ কম তেলে কম মশলায় রান্না তো। আমার মার রান্নার মতো। শকুন্তলা ভালো রাঁধে। শকুন্তলার বেশ প্রশংসা করলো বিজয়। চৈতালীর থালায় নিজে খাবার বেড়ে দিল। খাওয়া শেষ হলে রান্নাঘরে গিয়ে নিজের থালা নিজেই ধুয়ে রেখে এলো। পরিপূর্ণ ভদ্রলোক। দেখে বেশ ভালো লাগে চৈতালীর। কলকাতায় আজ অবধি এমন ভদ্রলোক সে দেখেনি। খেয়ে ওঠার পর বিজয় বললো চৈতালীকে কাল ডিনারে নিয়ে যাবে সে, কলকাতার সবচেয়ে ভালো বাঙালি খাবারের রেস্টুরেন্টে। শকুন্তলা জিজ্ঞেস করলো, বিজয়ের মা কী কী রাঁধেন, শুধু মারাঠী রান্না, নাকি বাঙালি রান্নাও? বিজয় অনেক ক্ষণ চুপ হয়ে থেকে বলে যে তার মা মারা গেছেন এক বছর হল। সড়ক দুর্ঘটনায়। বিজয় মায়ের সঙ্গেই থাকতো। বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে দাদা। গাড়িটা সেদিন চালাচ্ছিল বিজয় নিজে। দাদার বাড়ি থেকে রাতের খাবার খেয়ে ফিরছিল বান্দ্রায় নিজের বাড়িতে। মদ্যপান করেছিল। বোমার মতো একটা ট্রাক ছুটে আসছিল তার গাড়ির দিকে, দেখতে পায়নি। ট্রাক এসে ধাক্কা মারলো, আর গাড়িটা গড়াতে গড়াতে খাদে পড়ে গেল। ওখানেই মারা যায় মা। বিজয় চোট পেয়েছিল, তবে হাসপাতালে দুদিন থাকার পর তা সেরে যায়। সেদিনের পর থেকে বিজয় আর মদ ছোঁয়নি। মায়ের কথায় মায়ের কথা আসে। শকুন্তলাও মায়ের গল্পে যোগ দেয়। চৈতালী অনেকদিন ভুলে ছিল নিজের মাকে। আজ যেন মা তার সামনে এসে বসেছে। স্মৃতির ঝাঁপি সকলেই খুলে বসে। স্মৃতির সঙ্গে অনেক দুর কুয়াশায় হাঁটতে হাঁটতে সকলের চোখ ভিজে ওঠে। বিজয় তার মায়ের প্রসঙ্গ না তুললে সম্ভবত চৈতালী ভুলেই থাকতো মাকে। বারোটা বেজে যায়। বিজয় জিজ্ঞেস করে, আমি কোথায় ঘুমোবো?
চৈতালী কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর হেসে বলে শকুন্তলাকে, গেস্টরুমের বিছানাটা ঠিক করে দাও দিদিসোনা। চাদরটা চেঞ্জ করে দিও। আমার বেডরুমে এক্সট্রা বালিশ আছে, নিয়ে যেও।
বিজয় আগে কখনও কলকাতায় আসেনি। চৈতালী বলে, কাল তোমাকে ইণ্ডি য়ান মিউজিয়ামে নিয়ে যাবো, আর মার্বেল প্যালেসে। তোমার ভালো লাগবে।
বিজয় অ্যাট হোম বইটি হাতে নিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, এই বইটা কি রাতে পড়ার জন্য নিতে পারি? এটা আমার পড়া হয়নি।
.
৩. যে কটা দিন ছিল বিজয়, কিশোর বয়সীদের মতো চৈতালী আর বিজয় কলকা তার রাস্তায় ঘুরেছে। ঝড়বৃষ্টি মানেনি। আগুন-রোদ মানেনি। রাস্তার কিনারের তেলেভাজা থেকে ভজহরি মান্না, কোনও খাবারই বাদ দেয়নি। হাতে-টানা রিক্সায় চড়েছে, গঙ্গায় নৌকো চড়েছে, যেদিকে খুশি সেদিকে হারিয়েছে। গন্তব্যহীন চলায় অদ্ভুত আনন্দ, চোখে পড়ার মতো কিছু নয়ও চোখে পড়ে। কলকাতায় জন্ম আর বড় হওয়া চৈতালীর। অথচ বিজয়ের সঙ্গে কলকাতা দেখতে গিয়ে টের পেয়েছে কলকাতার অনেক কিছু সে জানতো না। অনেক ঘ্রাণ সে নেয়নি আগে। যেন একটা অচেনা শহর। বিজয় কৌতূহলী লোক। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখেছে সব, রাস্তার কিনারে কলের জলে দুপুরের বীভৎস গরমে স্নান করতে থাকা ছেলেদের সঙ্গে সাবান মেখে দিব্যি স্নানও করে নিয়েছে। তিলজলার বস্তিতে ঢুকে লোকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দুএকজনের সঙ্গে বেশ ভাব করে ফেলেছে। চৈতালী ভুলে গেছে তার চাকরি বাকরি, তার কন্যা, তার অতীত ভবিষ্যত। যেন সে পৃথিবী থেকে অনেক দুরে, সবার নাগালের বাইরে, কোনও অচেনা আকাশে সে। সত্যিকার ক্লাউড নাইন বোধহয় একেই বলে। শকুন্তলাকে বিজয় উপহার দিয়েছে দুটো চমৎকার ঢাকাই শাড়ি, এত ভালো শাড়ি নাকি শকুন্তলা ইহজন্মে পরেনি। চৈতালীর জন্য যোগেন চৌধুরীর একটা পেইন্টিং। জীবনের অনেক কথা বলেছে সে বিজয়কে। স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের কথা, মেয়ের কথা, অশোকের কথা, এক রাশ দুঃখ সুখের কথা। সব চুপচাপ শুনেছে বিজয়। বিজয়ও বলেছে, তবে বলার চেয়ে বিজয় শুনতেই বেশি পছন্দ করেছে। মাত্র কটা দিনে খুব আপন হয়ে উঠেছে বিজয়। যেন বিজয় তার ছোটবেলার কোনও বন্ধু। যেন বিজয়ের সঙ্গে শৈশব কৈশোর জুড়ে চৈতালী এক্কা দোক্কা খেলেছে, মার্বেল লাটিম খেলেছে, পুকুরে মাছ ধরেছে। মাঝে মাঝে অতীতের কোনও ঘটনা বলতে গিয়ে চৈতালীর দুচোখ জল-আসে জল-আসে মতো হয়েছে। আলতো করে বুকে টেনে তাকে শান্ত করেছে বিজয়। বিজয়ের ওটুকু স্পর্শই পেয়েছে। চৈতালি গোটা সাতদিনে। চুমু খেতে একবার দুবার চেয়েছিল, কিন্তু নিজেই বারণ করেছে নিজেকে।