শুনেছি নিজের মার রান্নার প্রশংসা সবাই করে। রান্নাঘরই মেয়েদের জায়গা, পুরুষতান্ত্রিক এই ধারণার বিরুদ্ধে আমি ভীষণ প্রতিবাদ করি। কিন্তু রান্নাকে আমি নিখুঁত এক শিল্প বলে মেনেই মাকে অসাধারণ শিল্পীর মর্যাদা দিচ্ছি, মা বলে মার প্রশংসা করছি না। শুধু মার নয়, নানির রান্নাও ছিল অতুলনীয়। নানির রান্নাঘরে পিঁড়িতে বসে ভাত খেতাম, মাছ বা মাংস দিয়ে খাওয়া শেষ হলে দুধভাত। দুধ খেলে, নানি বলতো, ব্রেন ভালো হয়। ছোট একটি শিং মাছের টুকরো, ছোট
একটি মুরগির পাখনা, বা খাসির নলি, আর তার ঝোল দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে কী যে ভীষণ তৃপ্তি হতো। এখন এক বেলাতেই প্রায় এক কিলো মাছ বা মাংস খাওয়া হয়ে যায়। এতেও সেই আগের তৃপ্তি জোটে না!
ছোটবেলার একটি দৃশ্য আমার খুব বেশি ভালো লাগতো। নানির ঘরে বিকেলে বই পড়া হতো, একজন পড়তো, বাকিরা চুপ করে সেই পড়া শুনতো। মামা, খালা, মা, নানি, পড়শি– সবাই শুনতো। কোনও ধর্মের বই নয়। গল্পের বই। ওই বই পড়া শুনতে শুনতেই, আমার বিশ্বাস, আমার বই পড়ার অভ্যেস হয়েছে। বই পড়ার অভ্যেস থেকেই গড়ে উঠেছে বই লেখার অভ্যেস। নানির ঘরের ওই চমৎকার দৃশ্যটা আর কখনও আমি দেখতে পাবো না, যখন ভাবি, বুকের ভেতর নিঃশব্দে একটা কষ্টের স্রোত বইতে থাকে। বইতে থাকেই। মা নেই। সেই মামারা নেই, যে খালা বই পড়তো, সেও নেই। কেমন একটা নেই নেই চারদিকে। শুধু দৃশ্যটা গেঁথে আছে হৃদয়ে।
ছোটবেলার আনন্দগুলো বড় তীব্র ছিল। পরার তিনটে জামা হলে যে সুখ পেতাম, এখন আলমারির তিনশ জামাও সেই সুখ দেয় না। ছোটবেলার অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। সকালে মুড়িওয়ালা যেতো। মুড়ি……র শব্দ শুনে দৌড়ে বেরিয়ে মুড়িওয়ালাকে বাড়িতে ডেকে আনতাম। বাবা পুরো মুড়ির টিনই কিনতো। সেই টিনের মুড়ি সারা মাস খাওয়া হতো। কত কিছু নিয়ে যে ফেরিওয়ালা যেতো! চুড়ি ফিতে যেতো দুপুরবেলায়। ওসবে একটুও আকর্ষণ ছিল না আমার। বাদামওয়া লা, বুটওয়ালা, চানাচুরওয়ালা আইসক্রিমওয়ালা যেতো। বিকেলে বারান্দায় বসে ঝালমুন মিশিয়ে চিনেবাদাম খেতে খেতে গল্প করার সেই আনন্দ এখন আর নেই। সেই দুপুরবেলার তেঁতুল, সেই রোদে দেওয়া মার বয়ামের আচার! ওই জীবন আর শত চাইলেও ফেরত পাবো না। যা গেছে তা যেন চিরকালের জন্যই গেছে। বাড়ির মাঠে সেই বৌচি খেলা, সেই চোর চোর, সেই হাডুডু, সেই মার্বেল, সেই লাটিম, ডাংগুলি– আর কি ফিরে আসবে কখনও। আজকালকার বাচ্চারা কমপিউটার গেইম খেলে, ভিডিও গেইম খেলে, এসবই তাদের ভালো লাগে। আমরা একালে জন্মালে আমাদেরও কমপিউটার গেইমই ভালো লাগতো, মাঠে মাঠে দৌড়োনোকে অহহীন বলে মনে হত। ভাগ্যিস তখন জন্মেছিলাম। তখন জন্মেছিলাম বলে ধুলো বালিতে গড়াগড়ি খেয়েছি, যন্ত্রহীন সমাজের স্বাদটা পেয়েছি। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে সন্ধেয় পড়তে বসেছি, হাতপাখায় বাতাস করে গ্রীষ্মকাল কেটে গেছে, বুঝিনি কখনও যে বৈদ্যুতিক বাতি বা পাখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। টেলিভিশন ছিল না, রেফ্রিজারেটর ছিল না, মোবাইল ফোন ছিল না, কমপিউটার ছিল না, কিন্তু কখনও মনে হয়নি কিছুর আর প্রয়োজন আছে, যা আছে তার বাইরে। এখন এই যন্ত্রনির্ভর, অর্থনির্ভর সমাজের অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। ইতিহাস পড়ে জানা, আর নিজে যাপন করে জানায় কিছু তো পার্থক্য থাকে। একালের জীবন সেকালের জীবন থেকে ভিন্ন। দুটো দুরকম সময়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এ আমাদের সৌভাগ্যই বটে। এক জীবনে কত কিছু দেখা হল। এখানে দাঁড়িয়ে অন্তত কিছুটা হলেও তো ধারণা করতে পারি ভবিষ্যৎটা ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে।
দিন দিন মানুষের ধন দৌলত বাড়ছে, জৌলুস বাড়ছে, ভোগ বিলাস বাড়ছে, সাজগোজ বাড়ছে। আগে আমাদের অল্পতে সুখ হতো, এখন অল্পতে সুখ হয় না। আগে দরিদ্র ছিলাম আরো এবং এখনকার চেয়ে সুখী ছিলাম আরও। সুখের সঙ্গে সত্যি বলতে কি ধন দৌলতের খুব একটা সম্পর্ক নেই।
সেক্সবয়
১. চৈতালী অপেক্ষা করছে সেক্সবয়ের জন্য। সন্ধেও নামবে, সেক্সবয়ও নামবে কলকা তায়। অন্ধকারের হাতে হাত ধরে দক্ষিণ কলকাতার এই গলিতে ঢুকবে বিমান বন্দর থেকে আসা সেক্সবয়ের ট্যাক্সি। বোম্বে থেকে আসছে সে। চৈতালীর বাড়িতেই উঠবে। দুজনের গত ছমাস যাবৎ প্রায় সব হয়েছে, শুধু সামনাসামনি দেখাটাই হয়নি। ফেসবুকে প্রথম কথা হয়, মূলত সেক্সের কথা। চৈতালীকে আকৃষ্ট করেছিল সেক্সবয় নামটি। প্রোফাইলের ছবিটি উলঙ্গ পুরুষের। এর সঙ্গে সেক্স ছাড়া আর কী বিষয়ে কথা বলা যায়! সেক্স নিয়ে কথা বলার জন্যই সেক্সবয়কে বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ জা নিয়েছিল চৈতালী। নিজের যৌনসম্পর্কহীন জীবন বড় দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। শহরে এত যুবকের ভিড়, আর চৈতালীর মতো সুন্দরী বিদুষী মেয়ের জন্য কোনও প্রেমিক জোটেনা! জুটবেই বা কী করে, জুটতে হলে যা যা করতে হয়, চৈতালী তার প্রায় কিছুই করে না। শহরটাকে আজকাল সয় না চৈতালীর। পার্টিতে যাওয়ার আমন্ত্রণ আসে, কিন্তু যায় না সে। ওই এক মুখগুলোর মুখোমুখি হওয়া, ওদের একই গল্প দুশ বার শোনা, ঠোঁটে নকল হাসি ঝুলিয়ে সকলকে হাই হ্যালো বলা অনেক হয়েছে, আজকাল আর ভালো লাগে না। তার চেয়ে সোশাল নেটওয়ার্কে নতুন মুখের সন্ধান। পাওয়া যায়, নতুন কথাও শোনা যায়। যে লোকটির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল চৈতালীর, সেটিও হয়েছিল বাবার ঠিক করে দেওয়া পাত্রর সঙ্গে। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে সুব্রতকে ডিভোর্স করেছে চৈতালী। এরপর একেবারেই যে কারও সঙ্গে কিছুই ঘটেনি তা নয়। বয়সে দশ বছরের ছোট এক সহকর্মীর সঙ্গে প্রায় একমাস-মতো একটা সম্পর্ক ছিল চৈতালীর। কিন্তু ওর, ওই সহকর্মীর, অশোকের, বিয়ের পর ওই সম্পর্কটা ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয় সে। চৈতালী চায়নি ঘরে তরুণী স্ত্রী রেখে তার সঙ্গে গোপনে শুতে আসুক অশোক। একটি ইংরেজি দৈনিকে চাকরি করে চৈতালী। অনেকদিনের চাকরি। অনেক দায়িত্ব। কিন্তু কোনও অফিসের কোনও বোঝা চৈতালী বাড়ি বয়ে আনতে চায় না। বাড়িতে থাকতে চায় সে ভাবনাহীন। সামান্য কিছুক্ষণ সময় নিজের জন্য রাখতেই তো হয়, কিছুক্ষণই তো সময়! ওদিকে মেয়ে পড়ছে দিল্লিতে। ওর খোঁজ খবরও করতে হয়। আজকাল মোবাইল যুগে খোঁজ খবরের ব্যাপারগুলো জলের মতো সোজা। অফিস তো অফিস, চৈতালী না থাকলেও অফিস থাকবে। মেয়ের জীবনও মেয়ের জীবন। চৈতালী মরে গেলেও মেয়ে দিব্যি মানিয়ে নেবে। চৈতালীর বাবা-মা মারা গেছেন। চৈতালীই ছিল একমাত্র সন্তান। মা বাবার কথা তার এখন খুব মনে পড়ে না। অফিস থেকে ফিরে আগে একটা বই নিয়ে বসতো, এখন ফেসবুক নিয়ে বসে। ফেসবুক যে কী ভয়ংকর এক নেশার মতো! আসলে, ফেসবুক নয়, সেক্সবয় প্রতিদিন যে বলছে চৈতালীর সঙ্গে বিছানায় সে কী কী। করবে, কী করে চৈতালীর সারা শরীরে চুমু খাবে, কী করে ঠোঁটে, বুকে আদর করবে, কী করে চৈতালীর স্বাদ নেবে, আর তাকে ঘনঘন শীর্ষসুখ দেবে — সেসব পড়ার নেশা। এই নেশাটা তাকে প্রচুর অস্থিরতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। এখন সে রাস্তাঘাটের বা অফিসের যুবকগুলোর দিকে আগের মতো অত চাই চাই চোখে তাকায় না। সেক্সবয় চৈতালীর দৈনন্দিন জীবনের অভাবগুলো অনেকটাই দুর করেছে। মনে মনে সে কৃতজ্ঞ সেক্সবয়ের কাছে। ফেসবুকেই সম্পর্কটা এখন আটকে নেই। দুমাস যাবৎ প্রায় প্রতিদিন কথা হচ্ছে ফোনে, আর শেষ কয়েকদিন স্কাইপেতে দুজনের সেক্সও ঘটেছে। ভারচুয়াল সেক্স। সেক্সবয়ের আসল নাম বিজয়, মারাঠী, আর্কিটেক্ট, বয়স পঁয়ত্রিশ। এর চেয়ে চমৎকার আর কোন জুটি! চৈতালীর সঙ্গে সত্যিকার সেক্সের প্রস্তাবটি চৈতালীই দিয়েছিল বিজয়কে। বোম্বে-কলকাতা আসা যাওয়ার ইটিকিটও ইমেইল করেছিল। টিকিট পেয়ে লেটস ফাঁক হোল উইক বলে লাফিয়ে উঠেছিল বিজয়। বিজয়কে ছুঁয়ে দেখতে চায় চৈতালী। সত্যিকার মৈথুন চাই, রক্ত মাংসের শরীর চাই, হস্তমৈথুন শরীর আর নিতে চাইছে না। সাতদিনের ছুটি নিয়েছে চৈতালী, আজ বিকেলেই অশোক জিজ্ঞেস করেছে, হঠাৎ এতদিনের ছুটি কেন? কোথাও যাচ্ছো? চৈতালী হেসে বলেছে, ক্লাউড নাইনএ যাওয়ার ফ্লাইট বুক করেছি। যাবি? বিয়েটা না করলে ঠিক ঠিকই যেতাম। চৈতালীর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। মনে মনে বলে ভাগ্যিস বিয়েটা করেছিলে। অশোকের জন্য সেই আকর্ষণ আর বোধ করে না চৈতালী, বিজয় এসে অশোকের জায়গা, চৈতালী জানেনা, কবেই দখল করে নিয়েছে। অশোকের বিয়ের পর বিজয়ের মতো একজন পুরুষেরই দরকার ছিল তার জীবনে, এরকম বানের জলের মতো কেউ, পুরোনো সব স্মৃতি খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নেবে, স্নিগ্ধ শীতল নতুনতা ছড়িয়ে তাকে আরও উজ্জ্বল করবে, যেন সে জন্ম নিল এইমাত্র, অতীত বলে কিছু ছিল না কখনও তার। অশোক অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছে, কী কারও প্রেমে পড়েছো নাকি, দেখতে আরও উজ্জ্বল হয়েছে। মিষ্টি হেসে চৈতালী বলেছে, এই, মুনা কেমন আছে? চলছে তো সব ঠিকঠাক? বলে, অশোকের উত্তরের জন্য না অপেক্ষা করেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে চৈতালী। প্রতিদিন যখন বেরোয় তার চেয়ে খানিক আগেই বেরিয়েছে। শরীর জুড়ে বিজয় তার। সকাল থেকেই শরীরে জোয়ার।