কলকাতায় দুহাজার চার সাল থেকে নিজের মতো বাস করতে শুরু করেছি সাহিত্যের গুরুকে গুরু-প্রণাম না করেই। তার ওপর আবার নিষিদ্ধ দ্বিখণ্ডিতকে হাই কোর্ট থেকে মুক্ত করিয়ে এনেছি। আমার স্পর্ধার ফল অবশ্য পেতে শুরু করেছি শীঘ্র। লক্ষ করলাম আমি প্রায় সবখানে ব্রাত্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বন্ধুরা, যারা একসময় আমারও বন্ধু ছিল, আমাকে রীতিমত ত্যজ্য করেছে। ধীরে ধীরে কিছু বড় পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা বন্ধ হয়ে গেল, কিছু বড় প্রকাশক আমার বই প্রকাশও বন্ধ করে দিলেন। আমি অনেকটা একঘরে। একসময় তো সরকার থেকে চাপ এলো আমি যেন কলকাতা ছেড়ে চলে যাই। যে গৃহহীন মানুষটা পশ্চিমবঙ্গকে ভালোবেসে সব ছেড়ে ছুঁড়ে এসেছিল, তাকেই কিনা তাড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। রাজনীতিতে কত কাণ্ডই ঘটে। কিন্তু তাই বলে সাহিত্যিক আচরণ করবেন রাজনীতিকের মতো। যখন আমি পশ্চিমবঙ্গের মাটি কামড়ে পড়েছিলাম, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন, পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় আমাকে তাড়াবার নানারকম আয়োজন করে হেরে। যাচ্ছেন, তখন স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফোন করে আমাকে বলেছেন রাজ্য ছাড়তে। বলেছেন, আমাদের কাছে খবর আছে, তোমাকে মেরে ফেলার জন্য একদল লোক তৈরি হচ্ছে, তুমি রাজ্য ছাড়ো। ঠিক যেমন দ্বিখণ্ডিত নিষিদ্ধ করার জন্য আজকাল পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমাদের কাছে খবর আছে, এই বইয়ের জন্য দাঙ্গা বাঁধবে, তাই আমরা বই নিষিদ্ধ করেছি, স্ফুলিঙ্গকে বারুদের কাছে যেতে দিইনি। শাসকের সুরে কথা বলতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
এই সমাজ সাংঘাতিক নোংরা আর পুরুষতান্ত্রিক বলে সুনীলকে বড় মানুষ আখ্যা দিয়ে গুণকীর্তন করে চাটুকাররা। যারা সুনীলের যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে, তারা মুখ বুজে থাকলেও জানে এবং মানে যে সুনীল মানুষ হিসেবে বড় ছিলেন না। সেদিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে এবং আরও মেয়েকে সুনীল যৌন হেনস্থা করেছেন, এ কথা বলার পর সুনীলকে দোষ দেওয়ার বদলে লোকেরা দোষ দিল আমাকে। ছি ছি করলো আমাকে। সুনীলও দিব্যি অস্বীকার করলেন খবর। যেমন অস্বীকার করেন। আমার বই নিষিদ্ধ করার জন্য তিনি যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন, সে সব ঐতিহাসিক ঘটনা। এত বড় লেখক কী নির্দ্বিধায় মিথ্যে বলেন! আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। আজ যদি কোনও সভ্য দেশে কোনও পুরুষ-লেখকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আসে, লোকেরা লেখককে, সে যত বড় লেখকই হোক না কেন, ছি ছি করবে। কিন্তু এ দেশে উল্টো। হবে না কেন, এখনও ধর্ষণের জন্য বেশির ভাগ লোকই ধর্ষিতাকেই দোষী সাব্যস্ত করে, ধর্ষককে নয়। এ দেশ থেকে এর চেয়ে ভালো আশা করার কী-ই-বা আছে। যত শত্রুতাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় করুন না কেন, আমি তাঁর শত্রুতা করিনি বা তাঁর পাকা ধানে মই দিইনি। নিজেকে শুধু নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছি। আমি বিশ্বাস করি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। আমি হয়তো কাছ থেকে তাঁর চরিত্রের মন্দ দিকটা দেখেছি, বাইরের লোকদের তা দেখা সম্ভব হয়না বলে ভালো দিকটাই দেখেন, তাতে কী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা তাঁরা যেমন ভালোবাসেন, আমিও তেমন বাসি। এবং এও জানি, সুনীল গঙ্গো পাধ্যায়ের মধ্যে যদি সামান্য কোনও সততা থেকে থাকে, আমার সতোর কারণে আমাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করেছেন তিনি। তাঁর অজস্র চাটুকার ছিল। চাটুকাররা প্রতি দিন তাঁর কাছে ভিড় করতো। ওদের ছাড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রাত কাটেনি, দিন। কাটেনি, কিন্তু ওদের তিনি খুব ভালোবাসতেন বা শ্রদ্ধা করতেন বলে আমার কখনও মনে হয়নি।
সেই দিনগুলো
শীতের সকালে উঠোনে দাঁড়িয়ে রোদ তাপাতাম। বড় থালায় করে গরম ভাপা পিঠে নিয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বস্তির কিশোরীরা আসতো। পিঠেগুলো পাতলা কাপড়ে ঢাকা থাকতো। কী যে অসম্ভব স্বাদ ছিল ওই সব পিঠের! ভাপা পিঠে বড় হয়ে খেয়েছি। কিন্তু অমন স্বাদ আর পাইনি।
নানিবাড়ির বরই ছিল শহরের সবচেয়ে সুস্বাদু বরই। বড় হয়ে বরই অনেক খেয়েছি। নানিবাড়ির বরইয়ের চেয়ে বেশি সুস্বাদু বরই আমি আর খাইনি। শুধু কি নানিবাড়ির বরই, আমাদের বাড়ির সেই পেয়ারা, সেই কাঁঠাল! কখনও কি অত ভালো পেয়ারা বা কাঁঠাল আর কোথাও খেয়েছি? খাইনি। একটুও বানিয়ে বলছি না।
মা রান্না করতো মাটির চুলোয়। কুঁকনি ফুঁকে ফুকে কী যে অসম্ভব কষ্ট করে আগুন জ্বালাতে হতো মাকে। সবসময় কাঠ থাকতো না, গাছগাছালির ডাল পাতা দিয়েই রান্না করতো মা। কিন্তু মা যা কিছুই রান্না করতো, সবকিছুর স্বাদ ছিল অবিশ্বা স্যরকম ভালো। বড় হয়ে সারা পৃথিবীর কত বড় বড় দেশের কত বড় বড় রেস্তোরাঁয় খেয়েছি। কত বড় বড় ব্যাংকোয়টে। মার হাতের ওই রান্নার চেয়ে সুস্বাদু আর কোনও রান্না আমি আজ অবধি খাইনি। এর কারণ কি এই যে ছোটবেলার স্বাদ গন্ধ স্মৃতির কোষে কোষে এমনভাবে ঢুকে যায় যে কিছুই আর একে সরাতে পারে না? নাকি অন্য কিছু! মা ছিল জাদুকরের মতো। মাঝারি কোনও হাঁস বা মুরগি রান্না করে বাড়ির বারোজন লোককে দুবেলা খাওয়াতো। তারপরও কিছু টুকরো রেখে দিত পরদিন সকালে রুটি-মাংসের নাস্তার জন্য। মার সবকিছুতে বড় জাদু ছিল। নিজের হাতে লাগানো নারকেল গাছের নারকেল দিয়ে মা তকতি বানাতো। যখনই তকতি খাই, মার ওই তকতির তুলনায়, বুঝি, যে, এ কিছুই নয়। মা প্রায় সারা বছরই নিজের বাগান থেকে তুলে শাক সবজি ফল মূল খাওয়াতো। ওগুলোর তুলনা ওগুলোই।