প্রশ্ন ১৩: এই শহরটাকে আপনার কেমন লাগে? কখনও কি মনে হয় এটাও আপনার ঘর? কী করতে আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে?
উত্তর: কোনও জায়গা জুমি, দেশ, বাড়ি আমার ঘর নয়। আমার ঘর মানুষ, মানুষের হৃদয়। পৃথিবীর যেখানেই যে মানুষেরা স্বপ্ন দেখে সুন্দরের, সত্যের, যাদের সহমর্মিতা, সমর্থন,, শ্রদ্ধা পাই, ভালোবাসা পাই, সেই মানুষেরাই আমার ঘর, আমার বাড়ি। সেই মানুষের হৃদয়ই আমার নিরাপদ স্বদেশ।
প্রশ্ন ১৪: আপনি কি ভবিষ্যতে গৃহস্থ জীবনে নিজেকে সেটেল কার কথা ভাবেন?
উত্তর: আমার যে জীবন, সে জীবন কি অগৃহস্থ জীবন? আমি কি কোনও ঘরে ঘুমোই না, চাল ডাল কিনি না, রাঁধি না, খাই না? ঘুমোই, রাঁধি, খাই। আমার ঘরে কি অতিথিরা আত্মীয়রা বেড়াতে আসে না? আসে। আতিথেয়তা পায় না? পায়। আপনি কি স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করাকে গৃহস্থ জীবন বলেন? ওইসব ক্ষুদ্র সংজ্ঞা থেকে আমি অনেককাল মুক্ত।
প্রশ্ন ১৫: তসলিমা নাসরিনকে একজন লেখক, একজন অ্যাকটিভিস্ট, একজন মানুষ হিসেবে কিভাবে দেখেন?
উত্তর: একজন সৎ মানুষ হিসেবে দেখি। একজন নিঃস্বার্থ, হৃদয়বান মানুষ।
প্রশ্ন ১৬: আপনি হিন্দি সাহিত্য জগতে এখন অনেকটাই পরিচিত। বাংলা এবং হিন্দি সাহিত্যকে কিভাবে তুলনা করবেন?
উত্তর: আমি যেহেতু বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা সাহিত্য শৈশব থেকে পড়ছি, সেহেতু বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আমার জ্ঞান অন্য সব সাহিত্য সম্পর্কে আমার যা জ্ঞান, তার তুলনায় অনেক বেশি। হিন্দি সাহিত্য পড়তে গেলে অনুবাদ পড়তে হয়। পড়েছি, যতটুকু পড়েছি, তাতে মুগ্ধ আমি। সব ভাষাতেই থাকে উঁচুমান, মাঝারিমান, নিম্নমানের রচনা। দীর্ঘকাল ধরে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা হচ্ছে বলে সম্ভবত বাংলায় উঁচু মানের সাহিত্যের পরিমাণটা বেশি।
প্রশ্ন ১৭: হিন্দি পাঠকদের জন্য কী বক্তব্য দেবেন? উত্তর: আমি রাজনৈতিক নেতা বা ধর্মীয় গুরু নই। ঘন ঘন বক্তব্য দেওয়ার বা ভাষণ দেওয়ার অভ্যেস নেই, উপদেশ বর্ষণও কম করি। আমার যা বলার, তা আমি লিখি। লেখকের কাজই তো লেখ।
সুনীল লেখক হিসেবে বড় ছিলেন, মানুষ হিসেবে বড় ছিলেন না
সুনীল লেখক হিসেবে বড় ছিলেন, মানুষ হিসেবে বড় ছিলেন না
যে কোনও মৃত্যুই খুব বেদনার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর শুনে আমি চমকেছি, বেদনাবোধ করেছি। বার বার ভেবেছি, কত লোক খামোকাই বেঁচে আছে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আরও কিছু বছর বেঁচে থাকলেই পারতেন, লিখতে পারতেন। আরও কিছু লেখা। আজকাল আটাত্তর বা উনাশি বছর বয়সকে মৃত্যুর উপযুক্ত বয়স বলে মনে হয় না। দীর্ঘকাল চলৎশক্তিহীন অবস্থায় বিছানায় পড়ে না থাকলে, মাথা সম্পূর্ণই অকেজো হয়ে গেলে, বয়স নব্বইএর ওপর না উঠলে মৃত্যুকে মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হয়।
প্রায় অর্ধেকদিন টেলিভিশন খোলা ছিল। টেলিভিশনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষদিককার কিছু ছবি দেখে অবাক হয়েছি। তাঁর স্বাস্থ্য যে এত ভেঙে পড়েছিল, জানতাম না। বড়ই রুগ্ন এবং অসুস্থ দেখাচ্ছিল। জানিনা কোনও কঠিন অসুখে ভূ গছিলেন কি না। অবাক হয়েছি আরও একটি কারণে, শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে দুএকজন যাঁদের আমি ব্যক্তিগত ভাবে জানি ভীষণ নিন্দা করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যা য়ের, ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন। প্রকাশ্যে মনের কথা বলার লোক এত কমে যাচ্ছে চারদিকে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ পড়ছি সেই কিশোর-বয়স থেকে। তাঁর খুব কম লেখাকেই যাচ্ছেতাই বা কিচ্ছু হয়নি বলে নাকচ করেছি। তাঁর যে জিনিসটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো, তা হল তাঁর নাস্তিকতা নিয়ে তাঁর লুকোছাপা না করা। ধর্ম নিরপেক্ষতা, দেশ ভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, হিন্দু-মুসলমান, বাংলা এবং বাঙালি, অস্তিত্ববাদ, মৃত্যু, অমরত্ব ইত্যাদি নিয়ে তাঁর যে মত ছিল, তা একেবারেই আমার মত এত মতের মিল যাঁর সঙ্গে, তাঁর সঙ্গে বিরোধ কেন! অবশ্য বিরোধটা আমার দিক থেকে কখনও ছিল না। তিনিই গোপনে গোপনে আমার পায়ের তলার মাটি সরাতে চেষ্টা করছিলেন। কেন করছিলেন, কী প্রয়ো জন ছিল তাঁর, আজও জানি না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চিনি বাংলাদেশ থেকেই, আশির দশকের মাঝামাঝি পরিচয়। বাংলাদেশে যখন যেতেন দেখা হত, কলকাতায় আমি বেড়াতে এলেও দেখা হত। বাড়িতে নেমন্তন্ন করতেন। কবিতা এবং কলাম লিখে তখন আমার বেশ নাম হয়েছে দেশে। তারপর বিরানব্বইয়ে আনন্দ পুর স্কার পাওয়ার পর তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়এর সঙ্গে ঘন ঘনই দেখা হল। অনেককে বলতেও শুনেছি, সুনীলই তো তসলিমাকে আনন্দ পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছে। আমিও তাই ভেবেছিলাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও এমন মন্তব্যের কখনও প্রতিবাদ করতে দেখিনি। বেশ কয়েকবছর পরে অবশ্য জেনেছিলাম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই আনন্দ পুরস্কার-বিচারকমণ্ডলীর দশ জন সদস্যের মধ্যে একমাত্র সদস্য যিনি আমার পুরস্কার পাওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। শুধু বিরানব্বইএ নয়, দুহাজার সালেও আনন্দ পুরস্কার পেয়েছি, তখনও তিনিই একমাত্র বিচারক যিনি চাননি আমার পুরস্কার জুটুক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখে অবশ্য কখনও আমি বুঝতে পারিনি তিনি গোপনে গোপনে আমার বিরুদ্ধে কাজ করেন। শিশির মঞ্চে আমার একক কবিতা পাঠ তিনিই তো উদ্বোধন করেছিলেন। বন্ধুর মতো, শুভাকাঙ্খীর মতো, দাদার মতো, পিতার মতো তিনি পাশে ছিলেন বলেই বিশ্বাস করতাম। অবশ্য সব ভাবনার অবসান হল, যখন তিনি প্রকাশ্যে আমার দ্বিখণ্ডিত বইটি নিষিদ্ধ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবদার করলেন, এবং বইটি শেষ অবধি নিষিদ্ধ করিয়ে ছাড়লেন। একজন লেখকের জন্য এর চেয়ে ভয়ংকর হৃদয়বিদারক ঘটনা আর কী থাকতে পারে, যখন সে প্রত্যক্ষ করে একজন শ্রদ্ধাভাজন বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক, প্রিয় লেখক, তার বাক স্বাধী নতার বিরুদ্ধে গিয়ে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এই অজুহাতে তার বই নিষিদ্ধ করার জন্য রাজামন্ত্রীর কাছে দৌড়ান। অবিশ্বাস্য সব বিরোধিতা করা সত্ত্বেও, স্বভাবসুলভ ব্যবহারই উপহার দিয়েছি। কখনও আমি ভুলে যাইনি তিনি আমার প্রিয় লেখক, কিশোর-বয়স থেকে আমি তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, কখনও ভুলে যাইনি অন্য একশ বিষয়ে তাঁর মতের সঙ্গে মেলে আমার মত। নিজেকে বুঝিয়েছি, তিনি মুখে আমার লেখা ভীষণ পছন্দ করেন বললেও হয়তো সত্যিকার পছন্দ করতেন না, সে কারণেই আমার পুরস্কার পাওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। নিজেকে বুঝিয়েছি, মুক্তচিন্তার পক্ষে বললেও তিনি হয়তো আমার লেখা পছন্দ করতেন না বলে আমার বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, এই যাওয়ার অধিকার হয়তো তাঁর আছেই।