উত্তর: ভারতের হায়দারাবাদে বই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মৌলবাদীরাআক্রমণ করার পর থেকে একটি অলিখিত চুক্তিই আমার ভারতবর্ষের সঙ্গে, জনতার ভিড়ে কোনও অনুষ্ঠান টনুষ্ঠানের মঞ্চে আমি উঠবো না। আমি তো ভীষণ চাই মানুষের মধ্যে থাকতে, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, মত বিনিময় করতে। কিন্তু আপাতত এটি সম্ভব নয়। আমার নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের পরামর্শ আমাকে মানতে হয়। সে কারণেই আমি হানসের অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি। আমি শুনেছি ওখানে অনেকে গিয়েছিলেন আমার সঙ্গে দেখা হবে এই আশায়। কিন্তু আমি খুবই দুঃখিত সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি বলে।
বাক স্বাধীনতা নিয়ে আমার লড়াই। হানসের অনুষ্ঠানে না যাওয়ার মানে কিন্তু এই নয় যে আমি বাক স্বাধীনতাকে মূল্য দিইনি। জীবনের নিরাপত্তার কারণে কোনও জায়গায় শারীরিক ভাবে উপস্থিত না থাকার অর্থ বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যাওয়া নয়। আমি আমার বাক স্বাধীনতা কী রকম রক্ষা করছি এবং অন্য সবার বাক স্বাধী নতার কতটা পক্ষে আমি, তা আমার বই এবং ব্লগগুলো পড়লেই যে কেউ বুঝবে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সেসব মত আমি প্রকাশ করছি। কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষী দের বাধা যেখানে আছে, সেখানে আমার অনুপস্থিতির জন্য আমাকে দোষ দেওয়া ঠিক নয়।
আমি আশা করছি, আমি বেঁচে থাকাকালীন সেই দিন যেন আসে, যে দিন ভার তবর্ষের কোথাও যেতে কোনও বাধা থাকবে না আমার। জনতার ভিড়ে আর সবার মতো আমিও আমার পরিচয়ে হাঁটতে পারবো। কোনও নিরাপত্তা রক্ষীর প্রয়োজন হবে না। মানুষের ভালোবাসাই হবে আমার নিরাপত্তা। সেই দিন যেন আসে, যতই ধর্মের সমালোচনা করি না কেন, কেউ মাথার দাম ঘোষণা করবে না, কেউ হত্যা করতে আসবে না, কেউ ফতোয়া দেবে না। আমিও একদিন কবিতা পড়তে পারবো আর সব কবিদের মতো, আমিও বইমেলায় অটোগ্রাফ দিতে পারবো আর সব লে খকদের মতো, আমিও সাহিত্য সংস্কৃতির পরবে অনুষ্ঠানে আমার মত প্রকাশ করতে পারবো, নির্ভয়ে, নিরাপদে।
প্রশ্ন ১১: হানস পত্রিকা বিগত দেড় বছর যাবৎ আপনার লেখার হিন্দি অনুবাদ প্রকাশ করছে। এই পত্রিকার সম্পাদকের প্রচেষ্টাকে কিভাবে স্বাগত জানাবেন?
উত্তর: আমি খুবই কৃতজ্ঞ রাজেন্দ্র যাদবের কাছে। ভারতবর্ষে যেদিন আমার বই নিষিদ্ধ হল, সেদিন থেকেই পাল্টে গেছে পুরো পরিবেশ। আমার বই প্রকাশ করতে প্রকাশকরা ভয় পান, আমার লেখা ছাপাতে সম্পাদকরা ভয় পান, সরকার আমার বিরুদ্ধে এই খবরটি মুসলিম মৌলবাদীদের এমনই ইন্ধন যোগালো যে দলে দলে তারা আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে শুরু করলো, পথে নামতে শুরু করলো, দেশ থেকে আমাকে তাড়ানোর দাবিও করতে লাগলো। যদি পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমার বইটি নিষিদ্ধ না করতো, তা হলে ফতোয়া, মাথার দাম ইত্যাদি কিছুই জারি হতো না। সবচেয়ে বড় দুঃখ এই, বই নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব কিন্তু মৌলবাদীদের কাছ থেকে আসেনি। কলকাতার কিছু ঈর্ষাকাতর লেখক সাহিত্যিকের কাছ থেকে এসেছে। সরকার বইটি নিষিদ্ধ করেছিল লেখকেঁদের দাবির কারণে। সরকার যখন কারও ধর্মীয় অনু ভূতিতে আঘাত লাগবে এই ছুতোয় বই নিষিদ্ধ করে, তখন তাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে সরকারই হাজার গুণ উসকে দেয়, আর সেই ধর্মের মৌলবাদীদের হাতেই অস্ত্র তুলে দেয় বইয়ের লেখককে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করার জন্য, তাকে হয়রানি করার জন্য, পেটানোর জন্য, হত্যা করার জন্য।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে এই ছুতোয় সরকার কোনও লেখকের বই নিষিদ্ধ করলে বইয়ের প্রকাশক, পত্রিকার সম্পাদক, এমনকী পাঠকও সরকার এবং মৌলবাদীদের ভয়ে তটস্থ থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনও ঠিক জানে না বাক স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা।
হানস পত্রিকার নীতির প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা। রাজেন্দ্র যাদবের মতো সাহসী এবং সৎ লেখকের অভাব খুব সমাজে।
প্রশ্ন ১২: হিন্দিতে অনুবাদ করা আপনার সাম্প্রদিক বই কতদিনে আশা করবো? বইটি কি নিয়ে?
উত্তর: যে বইটি বের হতে যাচ্ছে, সেটির নাম নির্বাসন। কী করে আমি প্রথমে পশ্চিমবঙ্গ থেকে, তারপর ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম, তারই কাহিনী। নির্বা সন আমার আত্মজীবনীর সপ্তম খণ্ড আমি তো সাত খণ্ডে রামায়ণের মতো আমার আত্মজীবনী লিখলাম। প্রথম খণ্ডটির নাম আমার মেয়েবেলা, ওটি আনন্দ পুরস্কার নামে বাংলা সাহিত্যের খুব বড় একটা পুরস্কার পেয়েছে। বইগুলোর সব খণ্ডই অনেক ভাষায় ছাপা হয়েছে। লোকে গোগ্রাসে পড়ে আত্মজীবনীগুলো। এসব তো কেবল আমার জীবনকাহিনীই নয়, আরো হাজারো মেয়ের জীবন কাহিনী। তৃতীয় খণ্ডটি দ্বিখণ্ডিত, যেটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কলকাতার একটি মানবাধিকার সংগঠন থেকে কিছু লোক দ্বিখণ্ডিত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। কলকাতা হাইকোর্ট নিষিদ্ধ হওয়ার মতো কিছু পায়নি বইটিতে। নির্দিধায় মুক্ত করে দিয়েছে। নিষিদ্ধ। হওয়ার দুবছর পর মুক্তি পেয়েছে বই। জনতা নিষিদ্ধ করে না বই। শাসকেরা করে।
দুষ্ট লোকদের দুষ্ট বুদ্ধিতে চিরকালই তারা বই নিষিদ্ধ করে আসছে। বই নিষিদ্ধ বড়ই নোংরা কাজ। বাংলাদেশের সরকার নোংরা কাজে রীতিমত হাত পাকিয়েছে। আমার পাঁচটা বই নিষিদ্ধ ও দেশে। দেশের মানুষগুলোও নোংরা, কেউ এ পর্যন্ত নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে ও দেশে মামলা করেনি।