রাষ্ট্র এবং রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা না করা হলে মানুষের দুর্ভোগের কখনও শেষ হবে না। সৎ এবং সাহসী মানুষদের খুন হয়ে যেতে হবে, পচতে হবে জেলে, নয়তো আমার মতো নির্বাসনে জীবন কাটাতে হবে।
প্রশ্ন ৭: এডওয়ার্ড স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়নি ভারত। আপনার কি মনে হয় রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া ভারতের উচিত ছিল?
উত্তর: প্রথমেই বলতে হবে, আমেরিকার উচিত হয়নি স্নোডেনকে ভোগানো। কী অন্যায় করেছে সে, ভেতরের লুকোনো খবরগুলো জানিয়ে দিয়েছে, এই তো? আমি খুব খুশি হতাম যদি স্নোডেন আমেরিকায় বসে এই কাজটা করতো এবং আমেরিকার সরকার তাকে কোনওরকম বিরক্ত না করতো। ইওরোপ যে এত মানবাধিকারের জন্য প্রাণপাত করছে, ইওরোপি, বিশেষ করে পশ্চিম ইওরোপ স্নোডেনকে রাজনৈ তিক আশ্রয় দেবে না কেন? ভারতের কথা উঠছে কেন! ভারত দিতেই পারে তাকে আশ্রয়। কিন্তু ভারত হয়তো ভাবছে এসময় আমেরিকার সঙ্গে শত্রুতা করা উচিত হবে না। ভারতের একশ রকম সমস্যা। এক ডজন মুসলিম মৌলবাদী রাস্তায় নেমে খানিকটা চেঁচালেই ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় আশ্রিত লেখককে রাজ্য থেকে বা দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার, সেখানে কী করে ভাববো স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে আমেরিকার মতো ভয়ংকর শক্তির বিরুদ্ধে ভারত দাঁড়াবে।
সারা পৃথিবী যখন স্নোডেনকে আশ্রয় দিতে পারছিল না, তখন ভারত যদি দিতে পারতো, তাহলে শুধু আমি কেন, ভারত নিয়ে গৌরব করতে পারতো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ। যা হয়নি, হয়নি। আপাতত স্নোডেন নিরাপদে রাশিয়ায়।
আমি যে অবস্থাটির স্বপ্ন দেখি, সেটি বিপদগ্রস্ত লেখক শিল্পীকে ভালো ভালো দেশগুলোর রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া নয়। আমি স্বপ্ন দেখি, কোনও দেশে যেন এমন অবস্থার সৃষ্টি না হয়, যে, দেশের লেখক শিল্পীকে বেরিয়ে যেতে হয় দেশ থেকে বেরিয়ে অন্য কোনও দেশে আশ্রয় চাইতে হয়। সবখানেই যেন মানুষের মত প্রকাশের অধিকার থাকে। সব অঞ্চলই, সব দেশই, পৃথিবীর সর্বত্রই যেন মানুষের জন্য নিরাপদ হয়।
প্রশ্ন ৮. এ বছর বেলজিয়ামে রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব আর্টস, সায়েন্স, এবং লিটারেচার থেকে পাওয়া অ্যাকাডেমি পুরস্কার ছাড়াও প্যারিস থেকে ইউনিভার্সাল সিটিজেনশিপ পাসপোর্ট পেয়েছেন। এই পাসপোর্টটা ঠিক কি রকম পাসপোর্ট? আপনার পাওয়া পুরস্কারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট কোনটি?
উত্তর: ইউনিভার্সাল সিটিজেনশিপ পাসপোর্ট অনেকটা প্রতিকী পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টটা সভ্য মানুষদের পাসপোর্ট, ভবিষ্যতের পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টে কিন্তু নিজের জেন্ডার, জাত, ধর্ম, চোখের রং, চুলের রং, গায়ের রং, দেশ এসবের উল্লেখ নেই। শুধু নিজের নাম আর বয়সটুকুই। এই পাসপোর্টে কোনও ভিসার প্রয়োজন নেই। এই পাসপোর্ট নিয়ে পৃথিবীর সব দেশেই ভ্রমণ করা যাবে। শুধু ভ্ৰমণ নয়, যে। দেশেই বা যে অঞ্চলেই বাস করতে চাও, সেখানে বাস করতে পারবে। বাধা দেওয়ার অসভ্য নিয়ম টিয়ম নেই। এ অনেকটা স্বপ্নের মতো। এই স্বপ্ন কোনওদিন হয়তো সত্যি হবে। কিন্তু আজ আমরা একটা স্বপ্ন তৈরি করলাম। যারা সুন্দরতম একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে, তাদেরই দেওয়া হয়েছে এই পাসপোর্ট।
জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা। আমার বই পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মেয়েরা যখন ভালোবাসেন, বলেন, আমার বই তাঁদের শক্তি সাহস বাড়ায়, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়, তখন বড় ভালো লাগে। এর চেয়ে বড় পুরস্কার একজন লেখকের আর কী থাকতে পারে।
প্রশ্ন ৯: বিগত দু মাসে আপনি কানাডা আর আয়ারল্যাণ্ডে অ্যাথিস্ট হিউম্যানিস্ট কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন। এরা বিশেষ কোনও সংগঠন? এদের প্রধান উদ্দেশ্য কি?
উত্তর: সারা পৃথিবীতেই বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মমুক্ত, যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন, মুক্তচিন্তার মানুষ আছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সংগঠন গড়েছেন। এই সংগঠনগুলো থেকে মাঝে মাঝেই সেমিনার আর কনভেনশনের আয়োজন করা হয়, যেখানে মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সৃষ্টিশীল চিন্তক লেখক, শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। যে ভাবনাগুলো রক্ষণশীল সমাজ মেনে নেয় না, সেই ভাবনাগুলো সকলে ওইসব সেমিনার আর কনভেনশনে নিশ্চিন্তে প্রকাশ করেন, আগ্রহী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ বি দ্বজ্জনের বক্তব্য শুনতে আসেন। বোদ্ধা শ্রোতা আর বক্তার মধ্যে মতের আদান। প্রদান হয়। সাধারণ মানুষকে বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহী করার, বিবর্তনের জ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রচার মাধ্যম থেকে ছড়িয়ে দেওয়ার, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার এসবের প্রতিবাদ করার প্রেরণা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, মানবাধিকার, নারীর অধিকার,
শিশুর অধিকার, সমকামী বা রূপান্তরকামীর অধিকারের পক্ষেও আমরা উচ্চকণ্ঠ কই। গণতন্ত্র, মানবতন্ত্র, আর বৈষম্যহীন সমাজের প্রতিষ্ঠার জন্য যা করা দরকার, সকলে মিলে তার পরিকল্পনা করি। মূলত আমাদের স্বপ্ন, একটি সুস্থ সুন্দর পৃথিবী তৈরি করা, যেখানে ধর্মের, পুরুষতন্ত্রের, শোষক শ্রেণীর অত্যাচার নেই।
প্রশ্ন ১০: আপনি দীর্ঘদিন ধরে বাক স্বাধীনতার পক্ষে এবং সাহিত্যিক প্রতিবন্ধনের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এ বছর ৩১ জুলাই হানস পত্রিকা তাদের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে আপনাকে আমন্ত্রণ করেছিল। এই অনুষ্ঠানের মূল বক্তব্য যা ছিল, তা নিয়েই আপনার লড়াই। তাহলে সম্ভব হলো না কেন?