আমার ধারণা, আমাকে দেশে ঢুকতে দিলে মৌলবাদীরা যদি সরকারকে দোষ দেয়, দুটো ভোট যদি আবার নষ্ট হয়ে যায়, সে কারণে কেউ ঝুঁকি নেয় না। ন্যায়ের পক্ষে বা সত্যের পক্ষে রাজনীতিবিদরা খুব একটা দাঁড়ায় না। আমার পক্ষে কথা বললে কারও যেহেতু রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি হয় না, যেহেতু আমাকে তাড়িয়ে দিলে দেশের লোকেরা খুব বেশি প্রতিবাদ করে না, যেহেতু বছরের পর বছর আমাকে দেশে না ঢুকতে দিলেও সবাই নীরব থাকে, যেহেতু কোনও দল নেই, সংগঠন নেই আমাকে সমর্থন করার, সেহেতু আমার জন্য দরজা খোলার, কোনও সরকারই মনে করে না যে দরকার।
আমি সত্যি বলতে কী আশা ছেড়েই দিয়েছি।
প্রশ্ন ৩. ২০০৭ সালে আপনাকে কলকাতা ছাড়তে হয়েছিল। তারপর অনেক চেষ্টা করেছেন কলকাতা ফেরার, তা কিন্তু সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকার বদলেছে, এবং তারা পরিবর্তনের কথা বলছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কি মনে করেন আপনি কলকাতা ফিরে যেতে পারবেন? আপনি নতুন সরকারের কাছে আবেদন করেছেন কি?
উত্তর: অনেক চেষ্টা করেছি কলকাতায় ফেরার। নতুন সরকারের কাছেও আবেদন করেছি। কিন্তু ওঁরা রাজি নন। সিপিএমের সঙ্গে সমস্ত বিষয়ে তৃণমূল দ্বিমত পোষণ করলেও আমার বিষয়ে একমত। এ ক্ষেত্রে দুজনের অংকটা একদম মিলে যায়। এখন আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী, বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে আমি কোনও পার্থক্য দেখি না। দুটো অঞ্চল থেকেই একজন লেখককে অন্যায় ভাবে তাড়ানো হয়েছে, শুধু তাই নয়, তার আর ফিরতে না পারার ব্যবস্থাও পাকাপাকি করে রাখা হয়েছে। বড় লজ্জা হয় ওঁদের জন্য। বড়ই ক্ষুদ্র মানুষ ওঁরা। দূরদৃষ্টি তো নেই-ই, দুষ্টবুদ্ধিতে মাথাটা ভরে রেখেছে।
প্রশ্ন ৪. এশিয়ার বাইরে আপনার সমর্থনে এত বিদ্বান, এত সাহিত্যিক সামাজিক কর্মী এবং জন-সমগ্র এগিয়ে এসেছেন কিন্তু এখন পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশে একটিও সামাজিক সামগ্রিক আওয়াজ উঠলো না কেন আপনার পক্ষে?
উত্তর: এশিয়া এখনও প্রস্তুত নয় আমি যে কথাগুলো বলছি, সেগুলো মেনে নিতে। এশিয়া এখনও ঘোর পুরুষতান্ত্রিক, এখনও ধর্মান্ধ। তবে রাষ্ট্র বা কোনও হোমড়া চোমড়া কিছু সংগঠন দ্বারা স্বীকৃতি না পেলেও এশিয়ায় সাধারণ পাঠকদের প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। যারা ভালোবাসে, সমর্থন করে, সম্ভবত তারা সংগঠিত নয় বলেই বড় আওয়াজ ওঠে না। না, আমি অসন্তুষ্ট নই। কী পাইনি ভেবে দুঃখ করার চেয়ে কী পেয়েছি তা ভেবে খুশি থাকায় বিশ্বাসী আমি।
প্রশ্ন ৫. আপনি যা কিছু করেছেন, তা ছাড়াও সাম্প্রতিকালে মালালা, আমিনা ওদুদ, বিনা শাহ এবং আরও অনেক আওয়াজ উঠেছে ধার্মিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, আওয়াজ উঠেছে পরিবর্তনের, বিশেষত মুসলমান মহিলাদের জন্য। এখান থেকে দশ কুড়ি বছর যদি এগিয়ে যান, তবে কি পরিবর্তন দেখতে পান, মুসলমান মহিলাদের জীবনে কি প্রগতি দেখতে পান?
উত্তর: দশ বা কুড়ি বছরে খুব যে পরিবর্তন দেখতে পাবো, তা মনে হয় না। মুসলিম দেশগুলোতে এখনও ইসলামি মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রচণ্ড শক্তিশালী। ব্যক্তিগত ভাবে কেউ কেউ প্রতিবাদ করছে বটে, তবে এ প্রতিবাদ যথেষ্ট নয়। যতক্ষণ না রাষ্ট্র শক্তি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, নারী-সংগঠন একযোগে মুসলিম মেয়েদের সমানাধিকারের ব্যবস্থা না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সত্যিকার প্রগতি কিছু ঘটবে না। সত্যিকার প্রগতি চাইলে রাষ্ট্র থেকে, সমাজ থেকে, শিক্ষা থেকে, আইন থেকে ধর্মকে দূর করতে হবে। ধর্মও থাকবে, নারী স্বাধীনতাও থাকবে, এ মুখের কল্পনা বিলাস। ধর্ম যেহেতু নারীর স্বাধীনতা এবং অধিকারের বিপক্ষে, তাই ধর্মকে, ধর্মের বৈষম্যকে, ধর্মের আইনকে মাথার ওপরে অক্ষত অবস্থায় রেখে নারীর সমানাধিকার সম্ভব নয়। আমি কিন্তু সব ধর্মের কথাই বলছি। আর সব নারী-বিদ্বেষী ধর্মের মতোই ইসলাম একটি নারী বিদ্বেষী ধর্ম। কেবল ইসলামই মন্দ, অন্য সব ধর্ম ভালো, এই উদ্ভট ভাবনা আমার নয়।
এতকালের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে যে ভীষণ রকম নারী-বিদ্বেষ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে, তা দুর করার জন্য শুভ বুদ্ধির সব মানুষকে কাজ করতে হবে। অন্যরা সমাজ বদলে দেবে, তারপর আমি ভোগ করবো, এটা ভেবে বসে থাকলে সমাজের বদল ঘটতে বড় দেরি হয়ে যায়। আমাদের জগত আমাদের সময়। আমাদের সমাজ। আমাদের জীবন। আমাদের সবারই দায়িত্ব একে সুন্দর করা। প্রজাতির অর্ধেকে নিগ্রহ করবো আর নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রজাতি আখ্যা দেবো এর চেয়ে হাস্যকর এবং দুঃখজনক ব্যাপার আর কী আছে!
প্রশ্ন ৬: এই উপমহাদেশে যেখানে ধর্ম আর রাজনীতি একই শরীরের দুটো হাত, একে অন্যের সঙ্গে জড়ানো। সেই অর্থে আপনি একটি আঘাতে দুবার বিধ্বস্ত হয়েছেন। আপনি ছাড়াও আরও অনেকে সেই আঘাতের শিকার। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য?
উত্তর: ধর্ম আর রাজনীতিকে মেশালে ধর্মও নষ্ট হয়, রাজনীতিও নষ্ট হয়। এ দুটোর আলাদা থাকাটা খুবই জরুরি। যে মানুষেরা বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে আলস্য বোধ করে, অথবা বিজ্ঞানকে জানতে গিয়ে দেখেছে রীতিমত কঠিন ব্যাপার এটি, তারা ধর্মে আশ্রয় নেয়, ধর্মে আরাম বোধ করে, যেহেতু ধর্মই সবকিছুর সহজ এবং চমৎকার সমাধান দেয়, ধর্ম সম্পর্কে জানতে কোনও বুদ্ধি খাটাতে হয় না, গভীরভাবে ভাবতে হয় না, কোনও প্রশ্ন করারও দরকার হয় না। যারা ধর্মের মতো অবিজ্ঞান আর নারীবিদ্বেষের একটা পিণ্ডের ভেতর নিজেকে পুরে সুখী হতে চায় হোক। কিন্তু দেশের রাজনীতি এই অবিজ্ঞান আর নারীবিদ্বেষের পিণ্ডের সঙ্গে ভাই পাবে কেন? এ দুটো ভাই পাতালে মানুষের মস্তিষ্ক নষ্ট হয়, পরিবার নষ্ট হয়, সমাজ নষ্ট হয়, দেশ নষ্ট হয়। সব নষ্টদের দখলে চলে যায়। রাজনীতির কাজ দেশের মানুষের দেখভাল করা। ঠিক ঠাক রাজনীতিটা হলে মানুষ সুখে স্বস্তিতে থাকে, অভাব, অনটন দূর হয়, সবার জন্য শিক্ষা স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা হয়, কাজকর্মের সুযোগ ভালো হয়, দুর্নীতি বদ নীতির প্রকোপটা কমে যায়। রাজনীতির মধ্যে ধর্মের ছিটে ফোঁটা ঢুকলেই সর্বনাশ। এ দুটোকে আলাদা করতে গিয়েই দেখেছি আমাকে প্রচণ্ড আঘাত করা হচ্ছে। শুধু আমি নই, আরও অনেকেই শিকার হয়েছে এই বীভৎস ধর্মরাজনীতির। ধর্মনির্ভর রাজনীতি সব দেশেই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। এর একটিই কারণ, ধর্মের সঙ্গে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর অধিকার, বাক স্বাধীনতা এসব যায় না। ধর্মের সঙ্গে চিরকালই এসবের বিরোধ।