সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার সব লিঙ্গের সমান। পুরুষ লিঙ্গের যেমন অধিকার, নারী লিঙ্গেরও একই অধিকার, উভলিঙ্গেরও একই। হেটারোসেক্সয়াল বা বিষমকামীদের অধিকার যতটুকু, সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামীদেরও ততটুকুই। এতে যাদের বিশ্বাস নেই, তাদের মানবাধিকারে বিশ্বাস নেই। যারা সমকামী আর রূপান্তরকামীদের নিগ্রহ করছে, যারা সিসজেণ্ডার আর বিষমকামী ছাড়া, অর্থাৎ পুং লিঙ্গের পুরুষ ও নারী-লিঙ্গের নারী ছাড়া আর সবাইকে, পুরুষ আর নারীর কাম ছাড়া আর সব কামকে অস্বাভাবিক আর প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করছে তাদের শিক্ষিত করা, সচেতন করা, মানুষ করা অত্যন্ত জরুরি। আকাটমূখের সংখ্যা বেশি বলেই তাদের মুখামি মেনে নিতে হবে, গণতন্ত্রও বলে না। গণতন্ত্র সব মানুষের সমান। অধিকারের কথা বলে। সমকামী বলে বা রূপান্তরকামী বলে যদি ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হয়, অধিকার কিছু কম জোটে কোথাও, তবে তা নিতান্তই বিষমতন্ত্র, গণতন্ত্র নয়।
রূপান্তরকামীদের মানবাধিকার নিয়ে সংগ্রাম চলছে চারদিকে। ওরা চাইছে। নিজের জেণ্ডার নিজের নির্ণয়ের অধিকার এবং সেই জেণ্ডারকে জনসমক্ষে প্রকাশ করার অধিকার, রূপান্তরকামী বলে নিগৃহীত না হওয়ার অধিকার, নিজের জৈবলি জকে পরিবর্তন করার অধিকার, লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার, মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত না হওয়ার অধিকার, যৌনসঙ্গমের অধিকার, বিয়ে করার অধিকার, সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার। যে সমাজে আজও নারীকে নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে লাঞ্ছিত হতে হয়, সে সমাজে সমকামী আর রূপান্তর কামীদের অধিকারের জন্য আরও দীর্ঘ দীর্ঘকাল সংগ্রাম করতে হবে, অনুমান করতে পারি। মানুষ প্রজাতি সেদিন সত্যিকার সভ্য হবে, যেদিন কোনও মানুষকেই নিজের মৌলিক অধিকারের জন্য আর লড়াই করতে হবে না।
সমকামী আর রূপান্তরকামীদের মানবাধিকার যেন লক্ষ্যন না হয়, তা লক্ষ রাখার দায়িত্ব সমকামী আর রূপান্তরকামীদেরই শুধু নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষমকামীদেরও। মানবতার জন্য সব মানুষকেই এগিয়ে আসতে হয়। সবাই যদি এগিয়ে নাও আসে, তাহলেও ক্ষতি নেই। লক্ষ লক্ষ লোক দল বেঁধে সমাজ বদলায় না। ইতিহাস বলে, হাতে গোণা কিছু সাহসী আর স্বপ্নবান মানুষই সমাজ বদলায়। একবিংশ শতাব্দী চলছে। মানুষ আর কবে সভ্য হবে? মাঝে মাঝে মনে হয়, এখনও বুঝি গুহায় বাস করছে মানুষ। হাজার বছর ধরে খেটে খুটে যা একখানা সমাজ বানিয়েছে, মূর্খর্তার জাঁকালো উৎসবই চলে প্রতিদিন। সমাজের চেহারা চরিত্র দেখলে মনে হয়, এগুলো আর কিছু নয়, এক একটা অন্ধকার গুহা। মানুষগুলো চোখ কান বন্ধ করে অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। গুহা থেকে বেরোচ্ছে না, চোখে আলো লাগবে এই ভয়ে। আলোর দিকেও তাকাচ্ছে না।
সাদামাটা সাক্ষাৎকার
হিন্দি সাহিত্য পত্রিকা হানসে আমি লিখি। কিছুদিন আগে হানস থেকে আমার একটি সাক্ষাৎকার চাওয়া হয়েছে। প্রশ্নোত্তরগুলো এরকম।
প্রশ্ন ১: শাহবাগ আন্দোলন, তারপর এখন যে জামাতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করার হাইকোর্টের রায়– কী মনে হয় আপনার, এটা কি জনগণের মধ্যে পরিবর্তন হচ্ছে, রাজনৈতিক বদল দেখা দিচ্ছে?
উত্তর: খুব ভালো একটা রায়। তবে এই রায়ের কারণে যে বাংলাদেশ একটা ধর্মীয় রাষ্ট্র থেকে এক তুড়িতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবে, তা নয় কিন্তু। গত তিন দশক থেকে যে ইসলামিকণ চলছে দেশে, তা এক রায়ে পিছু হঠবে না। ইসলাম আনা খুব সহজ, কিন্তু ইসলামকে দূর করা সহজ নয়। এ অনেকটা দুষ্ট ভাই রাসের মতো, একবার চলে এলো তো গভীর শেকড় গেড়ে বসবে। জামাতি ইসলা মির ওপর ধর্ম-নিরপেক্ষ অনেক মানুষেরই রাগ ছিল। কারণ এই দলটি ক্ষমতা পেলে ইসলামি শরিয়া আইন এনে দেশের সর্বনাশ করবে, মেয়েদের পাথর ছুঁড়ে মারবে, মুক্তচিন্তার লোকদের ধরে ধরে জবাই করবে। বর্তমান সরকারেরও একটা ভয়, এই দলটির সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতায় চলে আসতে পারে, যেহেতু এ ঘটনা আগে অনেকবার ঘটেছে, তাই এ দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি যখন জনতা তুলেছে, এবং তারাই তুলেছে, যারা আওয়ামী লীগকে ভোটে জিতিয়েছে, তাদেরও শান্ত করা গেলো, বিরোধী দলকেও আপাতত নিরস্ত্র করা গেলো। এখন নির্বাচনে জিততে হলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চালাতে হবে বিএনপির, জামাতকে বগলে নিয়ে বগল বাজিয়ে জিতে যাওয়ার আরামটা বন্ধ হবে। এইসব রাজনীতি সম্ভবত ছিল জামাতি ইসলামকে নিষিদ্ধ করার পেছনে। বিচার ব্যবস্থা রাষ্ট্র থেকে আলাদা হলেও অনেকটাই প্রভাবিত।
সব কিছুর পরও একটা ধর্ম-আক্রান্ত দেশে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে, এর চেয়ে বড় সুখবর আর কিছু নেই। এরপর মৌলবাদকে মানুষ কতটা প্রশ্রয় দেবে, সমাজের ওপর এর প্রভাব কতটুকু হবে, সবই নির্ভর করে দেশের মানুষের ওপর।
প্রশ্ন ২: আশা দেখতে পাচ্ছেন দেশে ফেরার?
উত্তর: আজ কুড়ি বছর নির্বাসন জীবন যাপন করছি। আওয়ামি লীগকে লোকে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ দল বলে। এই আওয়ামি লীগ যখন ক্ষমতায় এলো, অনেকে ভেবেছিল, এবার আমি দেশে ফিরতে পারবো। কিন্তু আওয়ামি লীগও বিএনপির মতোই আচরণ করেছে। আসলে আমি লক্ষ্য করেছি, আমার বেলায় সব রাজনৈতিক দলই একই ভূমিকা পালন করে। সকলেই আমার ঢোকার দরজায় তালা দিয়ে রাখে। নিজেরা চুলোচুলি করলেও আমার বেলায় সবাই হাতে হাত মেলায়। আমাকে আমার দেশে ঢুকতে না দেওয়ার কী কারণ, তা কোনও সরকারই আমাকে জানায়নি।