তুমি ট্রান্সজেণ্ডার, রূপান্তরকামী। তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করে এখন ট্রান্সসেক্সয়াল হয়েছো। তুমি সাজতে ভালোবাসো, গয়না পরতে ভালোবাসো, মেয়েদের পোশাক পরতে পছন্দ করো, পুরুষের সঙ্গে শুতে পছন্দ করো, তাই বলে কিন্তু তুমি লিঙ্গ পরি বর্তন করোনি। তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করেছো, কারণ তুমি মূলত নারী, তুমি তোমার মতো করে তোমার নারীত্বকে প্রকাশ করেছো। তোমার জেণ্ডার নারীর, তোমার শরীরটা দেখতে আকাশ বাতাস হাতি ঘোড়া এক্স ওয়াই যা কিছুই হোক না কেন, তুমি মনে প্রাণে, অন্তরে বিশ্বাসে নারী। যৌনসম্পর্কের জন্য পুরুষকে পছন্দ না করে, তুমি কোনও মেয়েকেও পছন্দ করতে পারতে। সম্ভবত তুমি মনে মনে বিষমকামী বা হেটারোসেক্সয়াল নারী বলেই পুরুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করেছো। তুমি কিন্তু তোমার প্রেমিক পুরুষকে বিষমকামিতার সুখ দিতে নিজের লিঙ্গ বদলাওনি, তুমি লিঙ্গ বদলেছো কারণ তোমার ভয়ংকর যন্ত্রণা হচ্ছিল একটা পুরুষের শরীরকে বছরের পর বছর অকারণে বহন করতে, এ অনেকটা কাঁধে হিমালয় নিয়ে হাঁটার মতো। ভালুকের ছাল পরে প্রতিটা দিন যাপন করলে আমার ঠিক কেমন বোধ হবে, ভাবি। ট্রান্সজে গুর বা রূপান্তরকামী মানুষদের বোধহয় ঠিক সেরকমই অসহ্য অস্বস্তি হয় আর ওই ওপরের আবরণটা খোলসটা ঝামেলাটা উপদ্রবটা খুলে ফেলতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। লিঙ্গ-বদল সব ট্রান্সরা করে না। কেউ কেউ করে। করুক বা না করুক, করার। অধিকার সবারই আছে। মানবাধিকার সবার জন্যই। জীবন একটাই, এই একটা মাত্র জীবনকে যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার সবার। লিঙ্গ যারা অক্ষত রাখতে চায় রাখুক, যারা একে কেটে বাদ দিতে চায় দিক, যে লিঙ্গকে তাদের মন বা মস্তিষ্ক নিজের লিঙ্গ বলে বিশ্বাস করে– সেই লিঙ্গকে যদি শরীরে স্থাপন করতে চায় করুক। অনা কাঙ্ক্ষিত অবাঞ্ছিত লিঙ্গের বোঝা শরীরে বহন করে জীবনভর ভোগা থেকে বাঁচুক। নারীর শরীরটাকে পুরুষের শরীর করে ফেলা, অথবা পুরুষের শরীরকে নারীর করে ফেল্লা যদি সম্ভব হয় তবে করবে না কেন? আমার শরীর নিয়ে আমি যা খুশি করবো, এতে অন্যের আপত্তি হবে কেন? শরীরটা আমার নাকি অন্যের?
লিঙ্গান্তর করে যদিও একশ ভাগ পুরুষ বা একশ ভাগ নারী হওয়া যায় না, কিন্তু যতটুকুই হওয়া যায়, তাতে যদি সুখ পায় মানুষ, সুখ পাওয়ার অধিকার তাদের একশ ভাগ।
নাতালি নামে আমার এক বন্ধু এখন আপাদমস্তক মেয়ে। কদিন আগে তার গোটা শরীরটাই ছিল পুরুষের। তার মন তার শরীরকে কখনও মেনে নেয়নি। শুধু নারীর পোশাক পরে নাতালির নারী হওয়ার সাধ মেটেনি, লিঙ্গ বদলে ফেলে সে তার সাধ মিটিয়েছে। নিজের শরীর নিয়ে যা কিছু করার অধিকার তার আছে। কাউকে কৈফিয়তই বা দিতে হবে কেন সে কী করেছে বা যা করেছে কেন করেছে? নাতালিকে মেয়ে বলে না মানা মানে নাতালিকে অশ্রদ্ধা করা, নাতালির মানবাধিকার, ট্রান্সঅ ধিকার লম্বন করা। পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মেছিল, সেই পুরুষাঙ্গটির কারণে লিঙ্গান্তরিত নাতালিকে এখন পুরুষ বলে সম্বোধন করলে তাকে ঘোরতর অপমান করা হয়। ওই কাজটা আমি অন্তত করিনি। তাকে মিস্টার এক্স বলিনি, মিস নাতালি বলেই ডেকেছি। যারা লিঙ্গ বদলে নিয়েছে শুধু তাদেরই কেন, শরীরে আস্ত একটি পুরুষাঙ্গ থাকা সত্ত্বেও যারা নিজেদের নারী বলে মনে করছে, বিশ্বাস করছে, তাদেরও নারী হিসেবেই সম্বোধন করা উচিত সবার।
পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ অথবা পুরুষ ও নারী, এ নিয়েই যদি মানুষের দুনিয়াটা হত, তাহলে দুনিয়াটা নিতান্তই বেরসিক, বিদঘুঁটে আর বোরিং কিছু একটা হত। ভালো যে দুনিয়াটা বিচিত্র। ভালো যে দুনিয়াতে দুটো লিঙ্গের বাইরেও তৃতীয় লিঙ্গ আছে। উভলিঙ্গের কথাই ধরি না কেন, পুংলিঙ্গ আর স্ত্রীলিঙ্গ এক শরীরেই জড়াজড়ি করে থাকে। প্রকৃতি যদি সবাইকে নারী ও পুরুষ হিসেবে চাইতো, তাহলে উভলিঙ্গ বলে কিছু থাকতো না দুনিয়ায়।
প্রচুর মেয়ে ওয়াই ক্রোমোজম নিয়ে দিব্যি জীপন যাপন করছে। জিনটা পুরুষের, কিন্তু অ্যান্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম থাকার কারণে অ্যান্ড্রাজেন রিসেপটর কম, ফলে পুরুষ হরমোন বেরিয়ে যে প্রাণকে পুরোপুরি পুরুষের প্রাণ করে গড়ে তুলবে, তা হয় না। কলকাতার পিংকি প্রামাণিক সম্ভবত এই সিনড্রোমের শিকার। আবার ওদিকে অনেকে আছে, জিনটা মেয়েদের, কিন্তু কনজেনিটাল অ্যাডরেনাল হা ইপারপ্লাসিয়া হওয়াতে মেয়েদের হরমোন জোটে না, সে কারণে তারা মেয়ে হয়েও ঠিক মেয়ে নয়। নারীর যৌন আকর্ষণ পুরুষের জন্য, আর পুরুষের যৌন আকর্ষণ নারীর জন্য, এটাই ন্যাচারাল, বা প্রাকৃতিক, বাকি সব অপ্রাকৃতিক, প্রকৃতিবিরুদ্ধ এরকম ভাবাটা সম্পূর্ণ ভুল। সমকামীর সংখ্যা দুনিয়াতে যে কম নয়, তা মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সব সমকামীকেই এক বাক্সে ফেলা যায় না। সমকামীরা যে সবাই একশভাগ সমকামী তা নয়। বাইজেণ্ডার বা উভকামীর সংখ্যাও প্রচুর। সব উভকামীও একশ ভাগ উভকামী নয়। পুরুষ আর নারীর প্রতি কোনও কোনও উভকামী একই রকম যৌন আকর্ষণ বোধ করে, কেউ কেউ আবার ভিন্ন রকম।
বিচিত্র সব কাম চারদিকে। কেউ কেউ বহুঁকামী বা পলিজেণ্ডার। কেউ আবার সর্বকামী বা প্যানজেণ্ডার। কেউ কিন্তু নিষ্কামী। কোনওরকম কামের বালাই নেই। খাঁটি এজেণ্ডার বা জেন্ডার-নিউট্রাল যাকে বলে। আবার জেণ্ডারইয়ারও আছে, যারা নিজেদের নারীও মনে করে না, পুরুষও মনে করে না, বা দুটোই মনে করে, দুটোতেই সাঁতার কাটে, তাদের যৌনপরিচয়-যৌনবোধ-যৌনতা সব একাকার হয়ে যায়। সব কামই, সব যৌন আচরণই যত কম সংখ্যক লোকই সে আচরণ করুক না কেন– প্রাকৃতিক, যেহেতু প্রকৃতিতেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে। বেশি সংখ্যক লোক যে আচরণটা করে, সেটাকেই ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। তা ধরলেও ভিন্নতাকে আর ভ্যারিয়েশনকে স্বাভাবিক বলে না মানার কোনও যুক্তি নেই। সংখ্যালঘুরা প্রকৃতির বাইরের কোনও ঘটনা নয়।