পিতৃতন্ত্র পুরুষ দ্বারা তৈরি পুরুষের আরাম আয়েস করার জন্য, প্রভূত্ব কায়েম করার জন্য একটি ব্যবস্থা। কিন্তু নারীর সাহায্য ছাড়া পিতৃতন্ত্র টিকে থাকতো না। নারীই পিতৃতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য পুরুষকে সব রকম সাহায্য করছে। আফ্রিকায়। মেয়েদের যৌনাঙ্গের অংশ অল্প বয়সেই কেটে ফেলা হয়, মেয়েরা যেন যৌন সুখ। কোনওদিন অনুভব করতে না পারে। অনেকের যৌনাঙ্গ আবার শেলাই করেও বুজিয়ে। দেওয়া হয়। অনেক মহিলাই এই কাজটা করেন। মেয়ে হয়ে নিজ হাতে মেয়েদের পঙ্গু করেন। শুধু আফ্রিকা নয়, ভারতের বহরা মুসলিমদের মধ্যেও যৌনাঙ্গ-কর্তনের রীতি আছে। এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়া সহ আরও কিছু দেশে এই কর্তন চলছে। যৌন পাচার তো চলছেই, যৌন দাসত্ব বা পতিতাবৃত্তি চলছে, মহিলারাও মহিলাদের বিরুদ্ধে জঘন্য এই নারী পাচারে সহায়তা করছে। মহিলারা পিতৃতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে চান, কারণ তাদের মাথায় এই বিশ্বাস ছোটবেলাতেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে পুরুষ বড় জাতের আর নারী ছোট জাতের মানুষ। নারী নিতান্তই পুরুষের ভোগের সামগ্রী। এ ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় নারীর নেই। এই জঘন্য নারীবিরোধী কূৎসিত মন্ত্র পুরুষের মাথাতেও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পিতৃতান্ত্রিক নিয়মই নারীরা মাথা পেতে বরণ করে নিয়েছে, এই নিয়মই বশংবদ ভূতের মতো পালন করছে, নারীকে অবমাননা করার, পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার সব নিয়মে নারীও অংশগ্রহণ করছে, সব রকম ধর্মীয় সামাজিক নারী বিরোধী অনু শাসন অনুষ্ঠান মহাসমারোহে পালন করছে। শিক্ষিত স্বনির্ভর নারীরাও এতে অংশ গ্রহন করছে। তারা করছে কারণ নারীর শিক্ষা আর স্বনির্ভরতা অর্জন করার মানে তারা কখনও মনে করে না যে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। নারীরা শিক্ষা আর স্বনির্ভরতা অর্জন করছে পিতৃতন্ত্রের গণ্ডির মধ্যে বাস করে এবং শিক্ষা ও স্বনিভ রতাকে ব্যবহার করছে নারীর স্বকীয়তা বিনাশে, এবং পুরুষের স্বার্থে, পুরুষতন্ত্রের বিকাশে। নারীর তথাকথিত এই শিক্ষা আর স্বনির্ভরতা বেশির ভাগই নারীর নিজের যত উপকারে লাগছে, পুরুষের লাগছে বেশি। পুরুষরা এখন শিক্ষিত স্ত্রী পাশে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে, পুরুষের পুত্ররা শিক্ষিত স্ত্রীর কাছে লালিত পালিত হচ্ছে, স্ত্রীর উপার্জিত অর্থ স্বামীর পকেটেই বেশির ভাগ যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক এখনও পুরুষরাই। নারীর উপার্জিত টাকা নারী কি খাতে ব্যয় করবে, সেই সিদ্ধান্তটি বেশির ভাগ নারীই নেয় না, নেয় পুরুষ। নারীর উপার্জিত টাকা নারীর যৌনাঙ্গের মত, বা জরায়ুর মতো অনেকটা। নারীর যৌনাঙ্গ কী খাতে ব্যবহার হবে, জরায়ু কী জন্য ব্যবহার হবে, কখন ব্যবহার হবে, কার দ্বারা ব্যবহার হবে, সেই সিদ্ধান্ত যার জরায়ু সে নেয় না, পুরুষ নেয়। অনেক স্বাধীনতাই মেয়েরা পাচ্ছে, রাস্তায় যাওয়ার, ইস্কুল কলেজে যাওয়ার, অফিস আদালতে যাওয়ার, কিন্তু যৌন-স্বাধীনতা এখনও পাচ্ছে। না। কারণ ওই বন্দিত্বই নারীর সত্যিকার বন্দিত্ব। পুরুষতন্ত্র নারীর যৌনাঙ্গকে খুঁটি দিয়ে বাধে। যৌন স্বাধীনতার মানে কিন্তু কখনও যার তার সঙ্গে শুয়ে বেড়ানো নয়। যৌন স্বাধীনতার মানে নিজের পছন্দ মতো মানুষের সঙ্গে শোয়া, এবং শোয়ায় সব সময় হাঁ নয়, না বলাটাও যৌন স্বাধীনতা। বলতে চাইছি, যৌন সম্পর্কে রাজি হওয়াই যৌন স্বাধীনতা নয়, রাজি না হওয়াও যৌন স্বাধীনতা।
মোদ্দা কথা হল, যৌনাঙ্গ-বন্দিত্ব, যৌন পরাধীনতা, কন্যাভ্রণ হত্যা, শিশুকন্যা হত্যা, পণ প্রথা, পণের অত্যাচার, বধূহত্যা, যৌন দাসত্ব বা পতিতাবৃত্তি, নারী ও শিশু পাচার, ধর্ষণ কোনও রোগ বা সমস্যা নয়, এসব হল রোগ বা সমস্যার উপসর্গ। রোগের নাম পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র। এদিকে আমরা উপসর্গ সারাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি, রোগ সারাতে নয়। রোগ না সারালে উপসর্গ কোনওদিন বিলুপ্ত হবে না, যত চেষ্টাই করি না কেন।
লিঙ্গসূত্র
তেরো বছর বয়স আমার তখন। একদিন শুনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র হঠাৎ মেয়ে হয়ে গেছে। নাম ছিল আবুল হোসেন, মেয়ে হওয়ার পর নাম হোসনে আরা। কদিন পরই লাল বেনারসি পরে হোসনে আরা বিয়ে করে ফেললো তার রুমমেটকে। ঘটনাটা আমকে খুব আলোড়িত করেছিল। খবরের কাগজে আবুল হোসেন আর হোসনে আরা ছবি পাশাপাশি ছাপা হত। আবুল হোসেন সবসময় মৌলানাদের স্কার্ফের মতো একটা স্কার্ফ পরতো, বুক আড়াল করার জন্য। ভেতরে। ভেতরে মেয়েই ছিল সে, কিন্তু জন্মের পর আত্মীয় স্বজন ভেবেছিল সে ছেলে, ভাবার নিশ্চয়ই কোনও কারণ ছিল। বড় হয়ে আবুল হোসেন বুঝতে পেরেছিল সে ছেলে নয়। লজ্জায় ভয়ে অনেক বছর কাউকে কিছু বলেনি। ছেলেদের হোস্টেলে থাকতো, সবাই তাকে ছেলে বলেই জানতো। কিন্তু একসময় অস্বস্তির চরমে পৌঁছে ডাক্তা রের শরণাপন্ন হল। ডাক্তার কী একটা অপারেশন করলেন, ব্যস, আবুল হোসেন মেয়ে হয়ে গেল। খবরটা পড়ে আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল হঠাৎ একদিন ছেলে হয়ে যাওয়ার। কিন্তু বুঝতাম, আবুল হোসেনের শরীরটা যেমন ভেতরে ভেতরে। মেয়ের শরীর ছিল, আমার শরীরটা ভেতরে ভেতরে ছেলের শরীর নয়। আসলে মেয়েদের ওপর পারিবারিক সামাজিক ধার্মিক রাষ্ট্রিক অত্যাচার এত বেশি হত যে ছেলেতে রূপান্তরিত হয়ে এসব থেকে বাঁচতে চাইতাম। অন্য কোনও কারণ ছিল। না। মেয়েদের পোশাক পরতাম, কিন্তু ফাঁক পেলেই ছেলেদের পোশাক পরার ইচ্ছে হত | তখনও আমাদের শহরের মেয়েদের মধ্যে ছেলেদের প্যান্টের মতো প্যান্ট পরার চল শুরু হয়নি। মনে আছে প্রথম যখন প্যান্টের কাপড় কিনে দরজির কাছে গিয়ে নিজের জন্য একখানা প্যান্ট বানানোর প্রস্তাব করলাম, দরজি বানাতে চাইল না, পরে দাদাকে দিয়ে অনুরোধ করার পর বানালো বটে, কিন্তু ছেলেদের প্যান্টের মতো সামনে চেইন দিল না, চেইন দিল কিনারে। বলার পরও পকেট দিল না প্যান্টে। প্যান্ট যদি নিতান্তই মেয়েরা পরতে চায়, তবে সেই প্যান্ট পুরুষের প্যান্টের চেয়ে ভিন্ন করে বানানোর জন্য সত্তর দশকের ময়মনসিংহে দরজিদের কায়দা কানুনের কমতি ছিল না। প্যান্ট পরাই তখন রেভুলুশান, সার্টের প্রশ্নই আসে না। অবশ্য সার্টও বানিয়েছিলাম, দরজিরা কায়দা করে ছেলেদের সার্টের চেয়ে একটু আলাদা করে বা নিয়েছিল। বুক পকেট তো দেয়ইনি, বরং বুকের ওপর অনর্থক দুতিনটে কুঁচি বসিয়ে দিয়েছিল। পরে অবশ্য দরজিকে বেশ ধমক টমক দিয়ে মেয়েদের পোশাক পুরুষের পোশাকের থেকে যে করেই হোক ভিন্ন করার ওদের দুষ্টুমিটা বন্ধ করেছিলাম। যেহেতু নিষেধ ছিল ছেলেদের পোশাকের মতো পোশাক পরা, নিষেধ ভাঙতেই ওই কাজটা করতাম। কিছু লোক নিয়ম বেঁধে দেবে কী করে হাঁটতে হবে, হাসতে হবে, কাঁদতে হবে, খেতে হবে, কী করে কথা বলতে হবে, কী বলতে হবে, কণ্ঠস্বরটা কতখানির পর আর ওঠানো চলবে না, কী পোশাকের বাইরে কী পোশাক পরা যাবে না, বাড়ি থেকে কখন বেরোতে হবে, কখন ফিরতে হবে, আর আমিও সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো, কোনও প্রশ্ন করবো না, এ মানা আমার সেই কৈশোরেই আমার মনে হয়নি যে উচিত। ছেলেদের পোশাক মেয়েদের পরতে হয় না- এই উপদেশ উঠতে বসতে শুনতাম বলে ছেলেদের পোশাক পরে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, যে, ইচ্ছে করলে যা খুশি পরা যায়। আমি তখন বুঝে পাইনি, ছেলেরাও কেন মেয়েদের জন্য বরাদ্দ পোশাক পরে বুঝিয়ে দেয় না যে তারাও নিয়ম মানে না। কেন তারা স্কার্ট পরে না, শাড়ি, কামিজ পরে না? পুরুষ তো কম বিপ্লব করেনি, তবে পোশাকের এই বিপ্লবে এত আপত্তি কেন? পরে অবশ্য বুঝেছি, মেয়েদের স্থান সমাজে এত নিচে নামিয়ে রাখা হয়েছে, যে, বেশির ভাগ পুরুষ মনে করে, নিচুদের পোশাক পরা মানে নিজে নিচু হওয়া, অথবা দ্বিতীয় লিঙ্গের পোশাক পরার অর্থ প্রথম লিঙ্গকে অপমান করা। আর ওদিকে মেয়েরা যারা পুরুষের পোশাক পরে, তাদের মধ্যে অনেকেই মনে মনে এই ভেবে সুখ পায়, যে, একটু বুঝি প্রভুদের কাতারে ওঠা গেল, মানটা বাড়লো। পুরুষ ক্রস-ড্রেসারদের অনেকে ট্রান্সজেণ্ডার বা রূপান্তরকামী হলেও মেয়ে ক্রস-ড্রে সারদের অনেকেই তা নয়। পুরুষ আর নারীর সামাজিক বৈষম্য না থাকলে সম্ভবত একই পোশাক পরতো উভয়েই। হাসপাতালে, জেলখানায় উভয়ের একই পোশাক। ডাক্তারিশাস্ত্রের চোখে সব রোগী, আইনের চোখে সব অপরাধী সমান বলেই হয়তো।