অনেকে বলে নারী শিক্ষিত হলেই নাকি নারীর সমস্যা ঘুচে যাবে। কিন্তু দেখা গেছে, শিক্ষিত নারী পুরুষতন্ত্রের নিয়মাবলি যত ভালো ভাবে শিখতে পারে, তত ভালো ভাবে অশিক্ষিত নারী পারে না। শেখার ক্ষমতা শিক্ষিতদের বেশি। শিক্ষিত মেয়েদের বিয়ে হলে ঠিক ঠিক তো বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। অশিক্ষিত, দরিদ্র মেয়েরা যেমন যায়। নিজের নামের পদবী ফেলে দিয়ে স্বামীর পদবী লুফে নিচ্ছে শিক্ষিত নারীরা। ছেলেমেয়েদের জন্য পিতার পদবী, মায়ের নয়। এর অর্থ, মহিলা এবং তার সন্তানেরা পুরুষ স্বামীর অধীনস্থ। মহিলা এবং তার সন্তানের মালিক পুরুষটি। পিতৃতান্ত্রিক নিয়মে একটি মেয়েকে থাকতে হবে শিশুকালে তার পিতার অধীনে, বিয়ের পর স্বামীর অধীনে, আর বৃদ্ধ বয়সে পুত্রের অধীনে। শাস্ত্রেও এ কথা লেখা আছে। ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমতি, স্বাধীনতায় নারীর কোনও অধিকার নেই।
নারীকে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী সারাজীবন পুরুষের অধীনে থাকতে হবে। তার নিজস্ব স্বকীয়তা বলে কিছু থাকতে পারবে না। এই হল সমাজের নিয়ম, এই নিয়মটাকে অক্ষত রেখে নারীর জন্য লেখাপড়া শেখা আর কাজ করে টাকা রোজগার কাটা মেনে নেওয়া হয়েছে ইদানিং, কিন্তু সমাজের পুরুষতন্ত্রের কাঠামোতে কোনো রকম পরিবর্তন আনতে দেওয়া হয়নি। মেয়েদের কাপড় চোপড় পাল্টেছে, একবার তারা নিজেদের আপাদমস্তক কাপড়ে ঢেকে রাখতে বাধ্য হচ্ছে, আরেকবার বাধ্য হচ্ছে। সব খুলে ফেলতে। তারা সেক্সয়াল অবজেকটিফিকেশনের শিকার, সবখানে। তারা কসমেটিকস মাখছে, কারণ পুরুষতান্ত্রিক জগত মেয়েদের মুহুর্মুহু উপদেশ দিচ্ছে। পুরুষের চোখে আকর্ষণীয় হতে, আকর্ষণীয় হওয়ার জন্য শরীরের মাপ কী হওয়া চাই, বুক কত, কোমর কত, নিতম্ব কত, সব বলে দেওয়া আছে, কালো আর বাদামী রংএর মেয়েদেরও বলে দেওয়া হয়েছে, তোমার রংটা খারাপ, যত সাদা হতে পারবে, তত তোমার আকর্ষণ বাড়বে। ত্বকের জন্য খারাপ এমন কেমিক্যালে বাজার ছেয়ে গেছে, ত্বকের রং উজ্জ্বল করার জন্য, ত্বকের ভাঁজ বন্ধ করার জন্য। মেয়েরা এক তাল মাংস আর মুখ-বুক-যৌনাঙ্গ ছাড়া আর কিছু না। মেয়েদের যে মস্তিষ্ক আছে, ওতে যে বুদ্ধি ধরে, তা কখনও ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। মেয়েরা হল পণ্য। পণ্যদের সাজতে হয়, ঝলমলে ঝকমকে হয়ে থাকতে হয়। সেভাবেই রাখা হয় মেয়েদের। কুমারীত্ব বজায় রাখতে হবে, পুরুষতন্ত্রের কঠিন নিয়ম। সব পুরুষই আকাঙ্ক্ষা করে কুমারী মেয়ে। একবার কারও সঙ্গে কোনও মেয়ের যৌন সম্পর্ক হয়েছে, এ খবর প্রচার হলে পুরুষেরা আর বিয়ে করতে ইচ্ছুক হয় না সেই মেয়েকে। আর বিয়ের পর বজায় রাখতে হবে সতীত্ব। এই নিয়মটিই তো যৌনাঙ্গে শেকল বা তালা পরানোর নিয়ম। নারীর যৌনাঙ্গ নয় শুধু, নারীর জরায়ুর মালিকও পুরুষ। পুরুষ বা স্বামী সিদ্ধান্ত নেয় কটা সন্তান একটা মহিলা গর্ভে ধারণ করবে, এবং কোন লিঙ্গের সন্তান সে জন্ম দেবে। জরায়ু নিজের, অথচ নিজের জরায়ুর ওপরও কোনও অধিকার নেই মেয়েদের। পুরুষের যৌনাঙ্গে কোনও তালা লাগানোর নিয়ম নেই। পুরুষের জন্য বরং সারা পৃথিবীতেই খোলা হয়েছে পতিতালয়, পুরুষ যখন খুশি যৌনইচ্ছা চরিতার্থ করতে পারে। কোটি কোটি মেয়েকে ছলে বলে কৌশলে এই সমাজ পতিতা বা যৌন দাসী বানায় পুরুষ যেন তাদের ভোগ করতে পারে, পুরুষের স্ত্রী থাকুক বা না থাকুক সে। কোনও বিষয় নয়।
একসময় পুরুষরাই ঘরের বাইরে যেত, লেখাপড়া করতো, মেয়েদের সে অধিকার ছিল না। একসময় শিক্ষিত পুরুষরাই বলল, মেয়েদের লেখাপড়া করা উচিত। উনবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষিত পুরুষেরা আসলে কামনা করেছিলেন শিক্ষিত যৌনসঙ্গীর। তাদের আশা পূরণ হয়েছে। মেয়েরা লেখাপড়া শিখেছে, বিদুষী হয়েছে।
বিয়ের বাজারে শিক্ষিত মেয়ে ভালো বিকোয়। তবে শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত হোক, প্রায় সব পুরুষই পণ দাবি করে। শিক্ষিত এবং ধনী হলে পণ আকাশ ছোঁয়া। নারী শিক্ষা নারী নির্যাতন ঘোচাবে, নারীর বিরুদ্ধে যে বৈষম্য, তা ঘোচাবে, এ বি শ্বাসযোগ্য কথা নয়। ইস্কুল কলেজ পাশ করলেই কেউ শিক্ষিত হয় না। বেশির ভাগ মানুষ পড়ালেখা শেখে পরীক্ষায় পাশ করার জন্য, আর ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য। সচেতন হওয়ার জন্য যে শিক্ষা, সত্যিকার আলোকিত মানুষ হওয়ার জন্য যে শিক্ষা, সে শিক্ষা অন্য শিক্ষা। আমরা যদি একটা সুস্থ সুন্দর সমাজ চাই, তবে মনে রাখতে হবে সেই সমাজে নারীর সমানাধিকার থাকতে হবে, নারী ও পুরুষের সম্পর্ক প্রভু ও দাসীর সম্পর্ক নয়, সম্পর্কে বন্ধুতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি থাকতে হবে। সমাজের তৈরি করা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে হবে। কিন্তু কজন বাবা-মা কজন সন্তানকে এই শিক্ষা দিচ্ছে যে নারী আর পুরুষের অধিকার সমান?
পুরুষের শরীর পেশিবহুল, কিন্তু আমরা সমাজ, বা রাষ্ট্র বা পরিবার পেশির জোর দিয়ে চালাই না, আমরা বুদ্ধি দিয়ে চালাই। বুদ্ধি নারী ও পুরুষের কারওর কারও চেয়ে কম নয়। নারী প্রমাণ করেছে, যে কাজগুলোকে এতকাল পুরুষের কাজ বলা হত, সেই সব কাজ নারী করতে সমর্থ। (অবশ্য এখনও পুরুষ প্রমাণ দেয়নি। নারী যে কাজে পারদর্শী, বা যেসব গুণ তাদের আছে সেসব কাজে পুরুষও পারদর্শী, সেসব গুণ তাদেরও আছে, যেমন বাচ্চা লালন পালন, সংসারের রান্না বান্না, ঘরদোর পরিষ্কার, সহানুভূতিশীল হওয়া, নরম নম হওয়া, কোমল হৃদয়ের হওয়া ইত্যাদি)।