কিন্তু যেহেতু আমি বিশ্বাস করি না মেয়ে বলে আমি কিছুটা কম মানুষ, যেহেতু বিশ্বাস করি না অধিকার বা স্বাধীনতা আমার কিছুটা কম হলেও চলে, তাই বলি, তাই লিখি, সময় সময় চেঁচাই। লিখি কেবল আমার জন্য নয়, লিখি তাদের জন্যই বেশি, যাদের জানতে দেওয়া হয় না কতটা অধিকার তাদের আছে নিজের জীবনটা নিজের পছন্দমতো যাপন করার। লিখে সেই মেয়েদের, সেই মানুষদের স্থবির জীবনে যদি সামান্যও তরঙ্গ তুলতে পারি, তবেই আমার লেখা সার্থক। সার্থক হই বলেই আর যা কিছুই ছাড়তে পারি, লেখাটা পারি না।
রোগের নাম পুরুষতন্ত্র
ইনদোরের এক লোক তার স্ত্রীর যৌনাঙ্গে তালা লাগিয়ে রেখেছিল চার বছর। স্ত্রী অতিষ্ঠ হয়ে বিষ খেয়ে মরতে যাচ্ছিল, তড়িঘড়ি তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করার সময় ধরা পড়লো তার যৌনাঙ্গ তালা বন্ধ। হাসপাতালে না নিয়ে গেলে কেউ জানতে পারতো না যে এই একবিংশ শতাব্দীতে আক্ষরিক অর্থেই যৌনাঙ্গ তালা বন্ধ করা হয়। যৌনাঙ্গের দুই অংশে সত্যিকার ছিদ্র করে ওতে তালার নল-অংশটা ঢুকিয়ে সত্যিকার চাবি দিয়ে তালা বন্ধ করে রাখা হচ্ছে প্রতিদিন। চাবি স্বামীর জিম্মায়। অন্য কোনও পুরুষাঙ্গ যেন ওই যৌনাঙ্গে প্রবেশ করতে না পারে সে কারণেই এই তালা চাবির আয়োজন। স্বামীর প্রয়োজনে স্বামী স্ত্রীর যৌনাঙ্গের তালা খোলে। এই খবরটা যখন পড়ি, আমার মনে পড়ছিল অন্ধকার যুগে ইওরোপের মেয়েদের শরীরে লোহার তৈরি সতীত্ব-বন্ধনী বা চেস্টিটি বেল্ট লাগানো হত। দুর দুরান্তে যাওয়ার আগে স্ত্রীদের যৌনাঙ্গে ভারী চেস্টিটি বেল্ট নামক লোহার খাঁচা পরিয়ে যেত স্বামীরা। স্ত্রীরা ওই লোহার খাঁচা খুলতে পারতো না যতক্ষণ না স্বামী এসে ওটির তালা খোলে। স্ত্রীর যৌ নঙ্গের মালিক স্ত্রী নয়, মালিক স্বামী। স্ত্রীরা ছিল পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি যে যেভাবে পারে রক্ষা করে। যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সেই অন্ধকার যুগে মেয়েদের যৌনাঙ্গে তালা লাগাতো, সেই একই মানসিকতা নিয়ে ইনদো রএর লোক তার স্ত্রীর যৌনাঙ্গে তালা লাগিয়েছে। সেই যুগ এবং এই যুগের মাঝখানে বেশ কিছু শতাব্দী পার হয়েছে, কিন্তু মানসিকতার কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। ঘটনা জানার পর লোকটিকে লোকে ছিছি করেছে, মাথা-খারাপ, বদমাশ ইত্যাদি বলে গালি দিয়েছে। অনেকে স্তম্ভিত, কারণ এরকম ঘটনা এ যুগে ঘটে না। তা ঠিক, সত্যিকার তালা লাগানোর ঘটনা ঘটে না, কিন্তু যে মানসিকতা তালা লাগায়, সেই মানসিকতাই সবার চারপাশে, সেই মানসিকতার লোকই আজকের সমাজ চালাচ্ছে। আসলে, তালা দৃশ্যমান হলেই লোকের আপত্তি। অদৃশ্য তালাতে কিন্তু কারও আপত্তি নেই।
নারী শুধু তার স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, পুরো সমাজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। নারী বিয়ের আগে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করবে কি না, বিয়ের পর কার সঙ্গে কিভাবে চলবে, কত রাত অবদি বাইরে থাকবে, কাদের সঙ্গে মিশবে, কাদের সঙ্গে মিশবে না, কার সঙ্গে হাসবে, কার সঙ্গে হাসবে না, বাড়িতে কে কে আসবে, কে কে আসবে না, কার সঙ্গে শোবে, কার সঙ্গে শোবে না, এ গুলো শুধু স্বামী বা পরিবার নয়, পুরো সমাজই বলে দেয়, বুঝিয়ে দেয়, বুঝতে একটু সমস্যা হলে আঙুল তুলে শাসিয়ে যায়। নারীর পান থেকে চুন খসলে চারদিকে অস্ত্র হাতে সৈন্যরা দাঁড়িয়ে থাকে হয় পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার জন্য, নয়তো একঘরে করার জন্য, নয়তো ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য।
অদৃশ্য তালা সমাজের প্রতিটি মেয়ের যৌনাঙ্গে। যে মানসিকতা সতীত্ব বন্ধনী বা দৃশ্যমান তালা পরাতে মেয়েদের বাধ্য করতো, সেই মানসিকতাই আজ অদৃশ্য তালা পরাতে বাধ্য করে। তালা দেখা যায় না, কিন্তু তালা আছে। এই অদৃশ্য তালা যদি সমাজের কোনও মেয়ের যৌনাঙ্গে না থাকে, তাহলেই বরং তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। সেই মেয়েকে সমাজে কেউ মেনে নেয় না যদি যৌনাঙ্গের অদৃশ্য তালাটি যথাস্থানে লাগানো না থাকে। এই অদৃশ্য তালার নাম পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র। পিতৃতন্ত্র বা পু রুষতন্ত্রের খাঁচায় নারীরা বন্দি, পারিবারিক এবং সামাজিক শেকলে নারী বন্দি, তার জন্য তাই আলাদা করে লোহার খাঁচা বা লোহার তালা বানাতে হয় না। পুরুষতন্ত্রর খাঁচা বাহ্যিক লোহার খাঁচা বা তালা বা শেকলের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত, অনেক বেশি শক্তিশালী। লোহার খাঁচা ভাঙা সহজ, পুরুষতন্ত্রের শেকল ভাঙা অনেক কঠিন। এই পুরুষতন্ত্রে পুরুষের ভূমিকা হল, প্রভু, কর্তা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক, ভোগ করার মালিক। মেয়েদের ভূমিকা হল, পুরুষের দাসী, পুরুষের যৌনবস্তু আর পুরুষের। সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। এটাই মূল ভূমিকা, নানারকম কায়দা কানুন করে, রং চং লাগিয়ে একে দেখতে ভিন্ন করা হয় বটে, কিন্তু যারা জানে, তারা জানে কাঠামোটাই দাঁড়িয়ে আছে বৈষম্যের ওপর। কাঠামোতেই যদি গলদ থাকে, তাহলে তার ওপর টাওয়ার বানানো হলে সেই টাওয়ারে ফাঁকি থাকে। ফাঁকি দিয়ে জীবন যাপন করা হচ্ছে। যার সঙ্গে সারাজীবন বাস করছো, তার সঙ্গেই প্রতারণ? কোনও প্রজাতি কি আছে যে নিজের প্রজাতিকে শুধু যৌনাঙ্গ ভিন্ন হওয়ার কারণে তাকে ঠকিয়ে, প্রতারিত করে, তার মানবাধিকার আর স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে নিজে মজা লোটে, সুখ করে? শুধু সে মেয়ে বলে? মুলে সমস্যা আর আমরা চাই বাইরেরটা গোছাতে, ওপরটা সুন্দর করতে, ওপরটা ঝকঝকে করতে। তাতে আসলে কাজ হয় না বলে। আজও নারীর বিরুদ্ধে একটি বৈষম্যরও বিলুপ্তি হয়নি। এখনও মেয়েরা যৌন দাসী, এখনও মেয়েরা যৌন পাচারের শিকার, এখনও গৃহহিংসা, অনার কিলিং, ধর্ষণ, গণ ধর্ষণ, কন্যাশিশু হত্যা, কন্যা-ভ্ৰূণ হত্যা, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক প্রথার শিকার। পণ দিতে অক্ষম হলে ঘরে ঘরে বধু পোড়ানো, বধু হত্যা চলছে– নারী বিরোধী কোনও নৃশংসতাই বিলুপ্ত হয়নি সমাজ থেকে।