–অবশ্য সব পুরুষ এক নয়। সব পুরুষই ধর্ষণ করে না।
–অবশ্যই সব পুরুষ এক নয়। অনেক পুরুষই নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করে। কিন্তু তাদের সংখ্যাটা নিতান্তই কম। এই সংখ্যাটা দ্রুত বাড়া উচিত। শুধু পুরুষ নয়, নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করা নারীর সংখ্যাও খুব বেশি নয়। ওই সংখ্যাটাও বাড়াতে হবে।
— আর আল্লামার কী হবে? ওর অনুসারীর সংখ্যা তো অনেক বেশি।
— সে ওর কৃতিত্ব। তোমরা পিতৃতন্ত্রকে আঘাত করতে পারোনি বলেই এমন হচ্ছে। মানুষকে বিজ্ঞান শিক্ষায় যথেষ্ট শিক্ষিত করতে পারেনি বলে মানুষ আজ অন্ধত্ব, কুসংস্কার, গোঁড়ামির মধ্যে বড় হচ্ছে। সমতা, সমানাধিকার, নারী-স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত করোনি বলে মানুষ আজ নারীবিরোধিতা, নারী-ঘৃণা, পুরু ষপ্রাইড ইত্যাদি নিয়ে বেড়ে উঠেছে। বেড়ে উঠেছে বলেই সহজেই আল্লামা শফীর কথাগুলো তাদের মনঃপুত হয়। শফীর প্রতিবাদ করে যত না কাজ হবে, তার চেয়ে বেশি কাজ হবে যদি প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করো মেয়েদের অধিকার সম্পর্কে, মানবা ধিকার সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জ্ঞান দিতে। ইস্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষা কম্পালসারি করো। ধর্ম শিক্ষা উঠিয়ে দাও ইস্কুলের সিলেবাস থেকে। মাদ্রাসা উঠিয়ে দাও। ধর্ম শেখার জিনিস নয়। ধর্ম বিশ্বাস করার জিনিস। হাবিজাবি আজগুবি অবাস্তব গল্প চোখ কান বুজে বিশ্বাস করার জিনিস। ও ঘরে বসে যত পারো বিশ্বাস করো। বাইরেটা ধর্মমুক্ত রাখো। বিজ্ঞানটা অবশ্য ভালো ভাবে অন্তঃস্থ করলে ধর্ম থেকে বিশ্বাস উঠবেই। এবং এতেই হবে পুরুষতন্ত্রের, ধর্মের, আল্লামা শফীর আর আল্লাহর নবীর ফতোয়াকে চ্যা লেঞ্জ করা। দুদিন মিছিল করে, তিনটে কলাম লিখে, চারদিন চিল্লিয়ে সমাজটাকে খুব বেশি বদলানো যায় না। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছোতে হবে তোমাদের। মুশকিল হল, বছরগুলোকে গড়িয়ে যেতে দিয়েছো, আর এই ফাঁকে শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে আল্লামারা। তাই ডাক দিলে পিঁপড়ের মতো লোক বেরিয়ে আসে রাস্তায়। চোখের সামনে কী দ্রুত তৈরি হয়ে গেল একটা গণ্ডমূখের সমাজ। বড় দুঃখ হয়।
রাফ খাতা
ছোটবেলায় আমাদের দু ধরনের খাতা থাকতো, রাফ খাতা, আর ফেয়ার খাতা। ফেয়ার খাতায় কোনও হাবিজাবি লেখা চলবে না। রাফ খাতায় চলবে। রাফ খাতায় থাকতো আমার রাজির হাবিজাবি। যে কোনও লেখাই রাফ খাতায় আগে প্র্যাকটিস করে পরে তবেই ফেয়ার খাতায় লিখতাম। রাফ খাতা ছিল স্বাধীনতা, ফেয়ার খাতা ছিল থমথমে একটা পরাধীনতা। রাফ খাতার মার্জিনে বা মাঝখানে, অংক করতে গিয়ে, বা নানা রকম বাড়ির কাজ প্র্যাকটিস করতে গিয়ে কত যে মনের কথা লিখেছি তার কোনও হিসেব নেই। বছর শেষ হলে নতুন ক্লাসে উঠলে পুরোনো বই খাতা সের দরে বিক্রি করে দেওয়া হত, আর বিক্রি না হলেও ওসব বাঁচিয়ে রাখা যেতো না, উইপোকা খেয়ে ফেলতো। লেখার হাতেখড়ি আমার রাফ খাতায়।
একসময় গোটা একটা রাফ খাতাকে লেখার খাতাই করে ফেললাম। ও নিয়ে ইস্কুলের লেখাপড়ার চেয়েও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। খাতাটা বাবা মার চোখের আড়ালে রাখতে হত। তবে লুকিয়ে ইস্কুলে নিতাম খাতাটা। ক্লাসের মেয়েরা কাড়াকাড়ি করে গোগ্রাসে পড়তো আমার লেখা। একসময় ওরা বাড়িতে নিয়ে যেতে শুরু করলো খাতা, পড়া শেষ হলে ফেরত আনতো, তখন আরেকজন পড়তে নিত। যার খাতা তার হাতে আসতে আসতে মাস চলে যেতো। দাদারা কবিতা-পত্রিকা। বার করতো, বাড়িতেই পত্রিকা ভাঁজ করে করে পোস্ট করা হতো গ্রাহকদের। ভাঁজে অংশ নিতাম, মুখস্ত করে ফেলতাম ছাপা হওয়া কবিতাগুলো। ওসবে দাদারা কবিতা লিখতো। তখনও কবিতা ছাপানোর মতো বয়স আমার হয়নি।
তবে বয়স হওয়ার আগেই আমার লেখা শুধু দাদাদের পত্রিকায় নয়, শহরের, এমনকী শহরের বাইরের লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হতে শুরু করলো, এমনকী জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হলো বেশ কিছু। আর বয়স হওয়ার আগেই, যখনও বাড়ির চৌকাঠ আমার ডিঙোনো নিষেধ, কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা আর প্রকাশনা দুটোই শুরু করলাম। তখন সবে সতেরো আমি।
সেই যে লেখার শুরু। আজও চলছে সেই লেখা। মাঝখানে গেল মেডিক্যাল কলেজের কঠিন পড়াশোনা, হাসপাতালের চাকরি– লেখার গতি কমেছে, কিন্তু লেখা ছাড়িনি। কেন ছাড়িনি, ছাড়তে পারিনি বলেই ছাড়িনি। কারণ যে কথা মনে আনাগোনা করে, সে কথা অন্য আর কোনও কিছু করে প্রকাশ করতে আমি পারিনা। আমি না জানি গান গাইতে, না জানি নাচতে। আমি না পারি নাটক করতে, না পারি ভালো ছবি আঁকতে। শুধু লেখাটাই জানি। লেখাতেই বলতে পারি কী বলতে চাইছি। যা লিখে বোঝাতে পারি, তা বলে বোঝাতে পারি না। বলতে গেলে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। মনে কী এমন কথা আমার যা প্রকাশ করতেই হবে? না, মনে নতুন কোনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নেই, গ্রহ নক্ষত্র আবিষ্কারের গোপন কোনও পরিকল্পনাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে না। খুব সাধারণ কিছু কথা মনে, না বললে আর সব মেয়েদের মতো চিরকালই কথাগুলো বুকের ভেতর পুষে রাখতে হবে। সাধারণ কথা, আমি কী চাই, কী না চাই, আমার কী ভালো লাগে, কী ভালো লাগে না, এসব। পুরুষেরা বলে। বেশির ভাগ মেয়েরাই বলে না, কারণ মেয়েদের অত কথা বলতে নেই, অত চাওয়া থাকতে নেই, অত নিজস্বতা থাকতে নেই, অন্যের ভালোয় মেয়েদের ভালো।