— মানুষ আবার দল বেঁধে বড় লোক কখন হলো? হয়তো কেউ কেউ ছোটলোক নয়। তবে আল্লামা যা বলেছে, তা বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের মনের কথা। হয়তো মেয়েদের ঠিক ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ানোর বদলে কেউ কেউ ক্লাস এলেন। টুয়েলভ অবধি পড়াতে চায়, কেউ এম এ, বি এ বা তারও বেশি পড়াতে চায়, কেউ কেউ মেয়েরা চাকরি করুক তাও চায়, তারাও দেখ গিয়ে মেয়েদের তেঁতুলের মতোই মনে করছে।
— আপনি বলছেন অন্য লোকও মেয়েদের তেঁতুলের মতো মনে করছে। শুধু আল্লামা নয়?
–তা তো নয়ই। অধিকাংশ লোকই মেয়েদের তেঁতুলই ভাবে। কেন, কত পু রুষ-কবি মেয়েদের কত ফুল-ফলের সঙ্গে তুলনা করেছে, পড়োনি? কমলা, ডালিম, নাসপাতি, আপেল, পেয়ারা, আনারস, গোলাপ, বেলি এরকম আরও কত নামে ডেকেছে মেয়েদের। কেবল তেঁতুল বললেই রাগ হয়? তেঁতুল খুব সস্তা ফল বলে? দামী ফলের সঙ্গে তুলনা করলে হয়তো এত রাগ হতো না। শুধু ফুল ফল! সবজিও তো আনা হয়েছে তুলনায়। পটলচেরা চোখ! শোনো, নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি যৌন আকর্ষণ থাকাটা অতি স্বাভাবিক। কিন্তু নারীকে নিতান্তই বস্তু ভাবাটা, যৌন-বস্তু ভাবাটা ঠিক নয়। যেন গোটা মানুষটা একটা ভ্যাজাইনা, গোটা মানুষটা একজোড়া স্তন, গোটা মানুষটা ত্বক, নাক চোখ, চুল; আর কিছু নয়। যেন মেয়েদের জ্ঞান বুদ্ধি, চিন্তা ভাবনা, ইচ্ছে অনিচ্ছে, নিজস্বতা, স্বকীয়তা, সম্মান, ব্যক্তিত্ব এসব নেই, বা থাকলেও এসবের কোনও মূল্য নেই। মেয়েরা যেন নিজের জন্য জন্মায়নি, জন্মেছে পুরুষের জন্য, পুরুষের যৌন তৃষ্ণা মেটানোর জন্য। তেঁতুলের প্রসঙ্গ তো এলো সে কারণে। ওই লোক কিন্তু পুরুষকে তেঁতুল বলেনি। মেয়েদেরও তো যৌন তৃষ্ণা আছে বাবা! যদি পুরুষের চোখে মেয়েরা তেঁতুলের মতো, মেয়েদের চোখে পুরুষও তো তেঁতুলের মতো। কিন্তু এরা মেয়েদের যৌনতাকে কোনওদিন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে তো করেই না, বরং অস্বীকার করে, ওটি থাকলে মেয়েদের বেশ্যা বলে গালাগাল করে। এদের চোখে, পুরুষ হচ্ছে ফুলফ্লেজেড হিউম্যান, আর মেয়েরা হচ্ছে সেক্স-অবজেক্টস কাম স্লেভস। পুরুষকে যৌনতৃপ্তি দেওয়ার, পুরুষের সন্তান জন্ম দেওয়ার, সেই সন্তানকে লালন পালন করার, ঘর সংসারের সব কাজকর্ম করার, রান্নাবান্না করার, পরিবেশন করার কাজ ছাড়া তাদের আর কোনও কাজ নেই। পুরুষের মা, স্ত্রী, বোন, কন্যা– এসবই হচ্ছে মেয়েদের পরিচয়। আর কোনও পরিচয় সমাজের কটা লোক মানে, বলো। পুরুষতন্ত্র হচ্ছে মেয়েদের বন্দি করে রাখার জন্য বোরখার মতো একটা বন্ধ কারাগার।
— কেউ তো আল্লামা শফীর মতো এমন আজগুবি কথা আগে বলেনি।
— সবাই বলছে। আল্লামা রাখঢাক না করে, একটু অসভ্য ভাষায় বলেছে, এই যা। সভ্য ভাষায় সভ্য লোকেরা যখন বলে, ওটা তোমাদের শুনতে অত মন্দ লাগেনা। কোরান হাদিসও ভালো করে পড়ে দেখ, এসব কথাই লেখা আছে। কোরান হাদিস হচ্ছে কট্টর পুরুষতন্ত্র। ঠিক আল্লামার মতো কথা বলে, চোদ্দশ বছর আগে একজন লোক আল্লাহর পেয়ারা বান্দা, বন্ধু, মেসেঞ্জার, রসুল ইত্যাদি বনে গিয়েছিল। সেই রসুলকে তোমরা মন প্রাণ ঢেলে শ্রদ্ধা করছো, তাকে বিশ্বাস করছো, আর ঠিক একই ধরনের কথা বললেও আজ আল্লামা শফীকে বিশ্বাস করছে না, তাকে বরং তোমরা ঘৃণা করছো। রীতিমত কন্ট্রাডিকটরি। কেন আল্লামাকে নিন্দা মন্দ করছো, সে তো তোমাদের রসুলে করিমের বিশ্বাসের উল্টো কোনও কথা বলেনি! রসুলের কথাগুলোই ইনোসেন্টলি ফুঁ গোপযুগী করে রিপিট করেছে আল্লামা।
–কী বলছেন?
— হ্যাঁ। যা বলছি ঠিকই বলছি। কী চাও? বৈষম্য নাকি সমতা, বর্বরতা নাকি মানবতা– একটাকে তোমাদের বেছে নিতে হবে। ধর্মে, সোজা কথা সাফ কথা– সমানাধিকার নেই, সত্যিকার মানবতাও নেই। আগেই বলেছি, ধর্ম আগাগোড়াই, মানে টপ টু বটম পুরুষতন্ত্র। যদি ইসলামে কারও অবিশ্বাস থাকে তাকে কুপিয়ে মেরে ফেলার কথা লেখা আছে। এর চেয়ে মানবতা বিরোধী কাজ আর কী হতে পারে। অ্যাডাল্টারি করলে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলতে হবে মেয়েদের। মেয়েদের আপাদমস্তক ঢেকে রাখতে হবে। কারণ তাদের দেখলে পুরুষের যৌন-ইচ্ছে জাগতে পারে। পুরুষের যৌন ইচ্ছে জাগতেই পারে, জাগুক। মেয়েদের যদি একই সঙ্গে সেই ইচ্ছেটা না জাগে, তবে পুরুষকে কন্ট্রোল করতে হবে। একই রকম মেয়েদের বেলাতেও। মেয়েরা তো কন্ট্রোল করছে, পুরুষরা কেন করবে না?
— পুরুষরা তো কন্ট্রোল করতে জানে না।
–কে বলেছে জানেনা? যারা জানে না তারা চরিত্রহীন, তারা বদমাশ, লোচ্চা। মেয়েদের বোরখা পরাটা প্রমাণ করে সমাজের সব পুরুষ চরিত্রহীন। মেয়েদের বোরখা পরিয়ে শুধু মেয়েদের ছোট করা হয় কে বলেছে, সত্যিকার ছোট করা হয় পুরুষদের। ওই সমাজের পুরুষেরা কোনও জাতের না, সব পুরুষই লিটারেলি এক একটা ডিকহেড, এটাই প্রমাণ করে। কে বলেছে পুরুষরা সেক্সের আর্জ কন্ট্রোল করতে জানে না? সভ্য সমাজে সভ্য পুরুষরা তো কন্ট্রোল করছে। তাদের মেয়েরা হাফ উলঙ্গ হয়ে চললেও পুরুষরাতো মনে করছেনা তাদের অধিকার আছে ওই মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার? তুমি বলছো তোমাদের সমাজে পুরুষরা কন্ট্রোল করতে জানে না! ঠেকায় পড়লে কিন্তু ঠিকই জানে। কিন্তু ঠেকা নেই তো এখন। পুরুষরা তোমাদের ব্যাকওয়ার্ড সমাজের মাতব্বর। মাতব্বরেরা মনে করে, তাদের যৌনআকাঙ্ক্ষা সংযত করার কোনও দরকার নেই। তারা যা খুশি করতে পারে। যার ওপর ইচ্ছে তার ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়ার, ধর্ষণ করার অধিকার তাদের আছে। তাদের পেশিতে শক্তি আছে, মেয়েদের ওপর পেশির শক্তি তারা খাটাবে। এই শক্তি আল্লাহর দেওয়া। জগতটা তাদের স্মৃর্তির জন্য। কিন্তু তা তো আসলে নয়। জগতটা নারী পুরুষ উভয়ের। পরস্পরের প্রতি সম্মান না থাকলে জগতটাতো চলবে না। মেয়েদের ঘরবন্দি না করে, বোরখা না পরিয়ে বরং পুরুষগু লোকে মানুষ করার চেষ্টা করো। পুরুষ লোচ্চামি করবে বলে প্রাপ্য অধিকার থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করার মতো অন্যায় কাজ আর কিছু নেই। আমরা যত সভ্য হচ্ছি, তত সমাজ পাল্টাচ্ছি। আমরা বলে কয়ে নিয়েছি যে আমরা পেশি দিয়ে বা পুরুষাঙ্গ দিয়ে জগত, রাষ্ট্র বা সমাজ চালাবো না। বুদ্ধি দিয়ে চালাবো। সুবুদ্ধি দিয়ে। সুবিবেচনা দিয়ে।