ফিদা হোসেন সেই সব ধার্মিকদের মতো, যারা নিজের ধর্মে বিশ্বাস রেখে অন্য লোকের অন্য ধর্মে বিশ্বাসকে নিন্দা করেন। ফিন্দা হোসেনের সঙ্গে নাম উচ্চারিত হতে, যদিও তিনি মহীরুহ,আমি তুচ্ছ তৃণ, আমার আগ্রহ হওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ আমি নাস্তিক, এবং তিনি শুধু আস্তিক নন, শুধু তাঁর নিজের ঈশ্বরের বেলায় তিনি আস্তিক। শত শত অন্য ঈশ্বর যে আছে জগতে, সেগুলো বিশ্বাসের প্রশ্ন উঠলে তিনি অবশ্য আস্তিক নন।
.
ফিদা হোসেনের সঙ্গে আমার মিল শুধু একটিই, প্রায় কাছাকাছি সময়ে একদল ধর্মান্ধ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে আমাদের। এ ছাড়া আর যা আছে সব অমিল। প্রথম অমিলটি হল, তাঁর নির্বাসনটি স্বেচ্ছা নির্বাসন, আমার নির্বাসনটি স্বেচ্ছার নয়। আমার কলকাতার বাড়ি থেকেই শুধু নয়, আমাকে ভারত থেকেই বের করে দেওয়া হয়েছে। না, কোনও ধর্মান্ধরা বের করেনি, বের করেছে স্বয়ং সরকার। ফিদা হোসেনের বাস করার বাড়ি ঘর আছে বিদেশে, আমার নেই। ফিদা হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার চেষ্টা করছে, আমাকে না বাংলাদেশের সরকার, না ভারতের সরকার ফিরতে দিচ্ছে। ভারত থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর যতবারই আমি ভারতে বাস করার জন্য ঢুকেছি, পত্রপাঠ আমাকে বিয়ে করে দেওয়া হচ্ছে। ফিদা হোসেন একটি ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন, আমি নারীর অধিকারের কথা বলতে গিয়ে সব ধর্মের নারীঅধিকারবিরোধী শ্লোকের সমালোচনা করে মুলত যে কথাটি বলি তা হল সমানাধিকারের ভিত্তিতে আইন তৈরি হোক, নারী বিরোধী আইন এবং সংস্কৃতির অবসান হোক, ধর্মের সমালোচনা করলে আমি সব ধর্মের সমালোচনা করি, নিজের আত্মীয় স্বজনের ধর্ম ইসলামকে বাদ দিয়ে করি না।
রুশদি এবং ফিদা হোসেনের মতো নাম যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি আমার নেই। কিন্তু তারপরও আমি তাঁদের নামের সঙ্গে আমার নাম কোনও কারণে উচ্চারিত হোক চাই না। দীর্ঘ বছর যাবৎ আমি যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছি ধর্মান্ধ এবং ক্ষমতাসীন সরকার দ্বারা, এই নির্যাতনের সামান্যও তাঁরা কেউ ভোগ করেননি। যেভাবে গৃহহীন অবস্থায় অনিশ্চয়তার অন্ধকারে দিনের পর দিন আমাকে বিদেশ বিভূঁইয়ে কাটাতে হচ্ছে, অসুখে অভাবে একা আমাকে নিজের বাঁচার সংগ্রাম, একই সঙ্গে নিজের আদর্শ এবং বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে, তা ফেলনা জিনিস নয়। রুশদি বা হোসেনকে এমন দুঃসহ অবস্থার ধারে কাছেও কাটাতে হয়নি। তাঁদের শিল্পের প্রতি আমি অপরিসীম শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে ওই দুজন পুরুষের সঙ্গে আমাকে এক ব্রাকেটে ফেলা অনুচিত। ধর্মমুক্ত ও বৈষম্যমুক্ত, সাম্য ও সমানাধিকার সম্বলিত একটি সমাজের জন্য আমার নিরন্তর সংগ্রাম মানুষ যে চোখেই দেখুক, আমার আদর্শের ধারেকাছে আসার কোনও যোগ্যতা তাঁদের নেই,তাঁরা যত বড় শিল্পীই হোক না কেন।
মেয়েরা নাকি তেঁতুলের মতো!
বাংলাদেশ থেকে খুব কমই ফোন আসে। বছরে একটি কিংবা দুটি। মাঝে মাঝে নিজেই আঁতকে উঠি। জন্মেছি, ও দেশেই কাটিয়েছি শৈশব কৈশোর যৌবন। ও দেশেই আছে আত্মীয় স্বজন, খেলার সাথী, ও দেশেই আছে একসময়ের সহপাঠীরা, সহকর্মীরা, লেখক-বন্ধুরা, অনুরাগী পাঠকেরা। দিব্যি ভুলে গেছে সবাই। তা যাক, আমিও ও নিয়ে দুঃখ করতেও অনেকদিন ভুলে গেছি। আজ কিন্তু ফোন আসা বা না আসা নিয়ে লিখতে বসিনি। লিখছি, কারণ বিকেলে একজন ফোন করেছিল দেশ থেকে। মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত | শাহবাগেও ছিল। আমার নিষ্ঠ পাঠক। বন্ধু। বললো, আপনি কিছু লিখছেন না কেন, এই যে মেয়েদের তেলের সঙ্গে তুলনা করলো আল্লামা শফী। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আল্লামা শফীটা কে, শুনি? কথোপকথনটা তারপর এভাবে এগোলো।
— হিফাজতে ইসলামের আমীর।
— হিফাজতে ইসলামটা কী?
–একটা মৌলবাদী দল। কয়েক লক্ষ লোকের মিছিল নামিয়েছিল ঢাকায়। এখন প্রচুর প্রতিবাদ হচ্ছে তার বক্তব্য নিয়ে। আপনার লেখা মিস করছি। লিখুন।
– কেন প্রতিবাদ হচ্ছে? কী বলেছে সে?
– জনসভায় বলেছে, আপনারা মেয়েদের স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে লেখাপড়া করাইতেছেন। কেন করাইতেছেন? তাদের ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়াইবেন যাতে বিবাহ শাদী দিলে স্বামীর টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারে। আপনার মেয়েকে স্কুল কলেজ, ভার্সিটিতে পড়াইতেছেন, লাখ লাখ টাকা খরচ করতেছেন। কিছুদিন পর আপনার মেয়ে, নিজে নিজে একটা স্বামী জোগাড় কইরা লাভ ম্যারেজ, কোর্ট ম্যারেজ কইরা চইলা যাবে। আপনার কথা স্মরণ করবে না। মহিলাদের ক্লাসে সামনের দিকে বসানো হয়, পুরুষরা কী লেখাপড়া করবে? আরও জঘন্য কথা বলেছে।
— যেমন?
— বলেছে, আপনার মেয়েকে কেন দিচ্ছেন গার্মেন্টসে কাজ করার জন্য? চাকরি তো অনেকে করতেছেন। আপনি নিজে করতেছেন, আপনার বউ করতেছে, মেয়েরা করতেছে। কিন্তু তারপরওতো পারতেছেন না। খালি অভাব আর অভাব। আগের যুগে শুধু স্বামী রোজগার করত আর সবাই মিইলা খাইত। এখন বরক্ত নেই। সবাই মিল্লা এত টাকা কামাইয়াও তো কুলাইতে পারতেছেন না।
গার্মেন্টসে কেন দিচ্ছেন আপনার মেয়েকে? সকাল ৭-৮টায় যায়, রাত ১০ ১২টায়ও আসে না। কোন পুরুষের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে, তুমি তো জান না। কতজনের সঙ্গে আপনার মেয়ে চলছে তা তো জানেন না। জেনা কইরা টাকা কামাই করতেছে, বরকত থাকবে কেমনে। মেয়েদের কাজ ঘরের ভেতর। নারীদের ঘরে থাকতে বলেছে ইসলাম। তোমরা জাহিলিয়াতের সময়ের মতো বেপর্দায় ঘর থেকে বাইর হইও না, উলঙ্গ অবস্থায় মাঠে-ঘাটে-হাটে আপনারা মহিলারা মার্কেট করতে যাবে না। স্বামী আছে সন্তান আছে তাদের যাইতে বলবেন। আপনি কেন যাবেন? আপনি স্বামীর ঘরের মধ্যে থাইকা উনার আসবাবপত্র এগুলার হেফাজত করবেন। ছেলে-সন্তান লালন পালন করবেন। এগুলা আপনার কাজ। আপনি বাইরে কেন যাবেন?