রুশদির নামের সঙ্গে আমার নাম জড়ানো হচ্ছে ১৯৯৩ থেকে। ইরানি ফতোয়া জারি হওয়ার পর রুশদি তখন আলোচিত এবং বিখ্যাত একটি নাম। এদিকে আমার মাথার দাম ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশ আর ভারতের সীমানার বাইরে লোকে সবে জানলো আমার নাম। আমি যখন অন্তরীণ অবস্থায় ছিলাম বাংলাদেশে, তখন অন্য সব ইওরোপের লেখকদের আমার পক্ষে খোলা চিঠি লেখার আন্দোলনে রুশদিও ছিলেন। এরপর যখন দেশান্তরী করা হলো আমাকে, নির্বাসন জীবনেই শুনেছি জা মানির এক পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সম্পর্কে আমার মন্তব্য পড়ে রুশদি নাকি রীতিমত রেগে আগুন। ওই পত্রিকায় আমি হতাশা প্রকাশ করেছিলাম এই বলে যে ফতোয়ায় ভয় পেয়ে রুশদির ক্ষমা চাওয়া নিশ্চিতই একটি কাপুরুষোচিত আচরণ।
.
রুশদি এখন নিউ ইয়র্ক শহরে বাস করছেন। নিউইয়র্ক শহরে আমিও বাস করছি। কিন্তু আমাদের দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তিনি আমেরিকার লেখক কবিদের যে বড় সংগঠন আছে, পেন ক্লাব, তার প্রেসিডেন্ট পদে বহাল। দু বছর ধরে পেন ক্লাব থেকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশাল অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন লেখককে নিয়ে আসা হয়েছে, প্রায় সবাই অচেনা। সালমান রুশদি জানেন যে আমি ভারত থেকে সবে বিতাড়িত হয়ে এসেছি। আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর যে আঘাত এসেছে তা ঘৃণ্য এবং অবিশ্বাস্য। আমার প্রায় সব বইই বাংলাদেশে হয় সরকারীভাবে, নয় সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ। শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, লেখার কারণে আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়ানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ সাড়ে সাত মাস আমাকে কলকাতায় আর দিল্লিতে গৃহবন্দি অবস্থায় রাখা হয়েছে তাড়ানোর প্র ক্রিয়া চালাতে গিয়ে। শেষ পর্যন্ত আমাকে ভারত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। জ্বলজ্বল করা আমার ইতিহাসকে ছলে বলে কৌশলে অস্বীকার করে সালমান রুশদি বাক স্বাধীনতার উৎসব করছেন। তিনি যা ইচ্ছে করতে পারেন। নিজের নিরাপত্তা রক্ষীদের একজন তাঁর বিরুদ্ধে বই লিখেছেন, সেই বই ছাপা না হওয়ার জন্য তিনি প্রকাশকের সঙ্গে ব্যবস্থা করে রেখেছেন। হ্যাঁ, তিনিই বাক স্বাধীনতার উৎসব করছেন। তিনি পুরুষ, ষাট পার হলেও কচি মেয়েদের দিকে লোভ করলে লোকে মন্দ বলে না। মেয়েরা যদিও অভিযোগ করেছে যে রুশদি তাদের যৌন বস্তু ছাড়া অন্য কিছু মনে করেন না, তাতেও লোকে ঘৃণা ছোড়ে না তাঁর দিকে। এই প্রচণ্ড পুরুষবাদী লেখক প্রচুর নাম, প্রচুর যশ, প্রচুর খ্যাতি পাওয়া লোক, তার সঙ্গে ফতোয়ার মিল ছাড়া আর কোনও মিল নেই বলে আমি স্বস্তি বোধ করি, এবং তাঁর নামের সঙ্গে আমার নাম কেউ যোগ করলে সত্যি বলতে কী, বিরক্তিবোধ করি আমি।
.
আরও একটা নামের পাশে আমার নাম গত দু বছর ধরে বেশ জড়ানো হচ্ছে। তিনি মকবুল ফিদা হোসেন। তিনি বিশাল শিল্পী। তাঁর ছবি ভারতে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়। তাঁকে ভারতের এক নম্বর শিল্পী বলে মনে করেন অনেকে। তিনি সম্প্রতি হিন্দুর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন সরস্বতীর উলঙ্গ ছবি এঁকে। হিন্দুরা তাঁর ছবি নষ্ট করে দিয়েছে, তাঁকে হুমকি দিয়েছে, তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আমি মানুষের একশ ভাগ বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। মকবুল ফিদা হোসেনের যা ইচ্ছে করে তাই তার আঁকার স্বাধীনতা আছে এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁকে এ কারণে অত্যাচার করার কোনও অধিকার কারও থাকতে পারে না। ফিদা হোসেনের মতো বিশাল একজন শিল্পীর নামের সঙ্গেও আমার মতো ক্ষুদ্র নামটি যুক্ত হলে আমি অস্বস্তি বোধ করি। কারণ ক্ষুদ্র হলেও আমি আমার আদর্শকে অত্যন্ত মূল্যবান বলে মনে করি, আমার আদর্শের সঙ্গে মোটেও মেলে না এমন কোনও মানুষ, সে মানুষ। পৃথিবীতে যে কোনও কারণেই হোক বিখ্যাত হলে তাঁর প্রতি আমার কোনও পক্ষপাত জন্ম নেয় না। তাঁর নামের পাশে আমার নাম উচ্চারিত হলে আমি সামান্যও পুলকিত হই না। মকবুল ফিদা হোসেনের উলঙ্গ সরস্বতী আঁকা নিয়ে ভারতে যখন বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে, আমি খুব স্বাভাবিক কারণে শিল্পীর স্বাধীনতার পক্ষে। মুসলমানদের মধ্যে যেহেতু নাস্তিকের সংখ্যা বিরল, ওরা ধর্মমুক্ত বা নাস্তিক হলে বিষম আরাম। বোধ করি। মকবুল ফিদা হোসেনের ছবি এরপর তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখি হিন্দু ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্ম নিয়ে, বিশেষ করে তাঁর নিজের ধর্ম ইসলাম নিয়ে তিনি কোনও ব্যঙ্গ করেছেন কীনা? দেখলাম কিছুই করেননি। বরং আরবিতে আল্লাহু শব্দটি লিখে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাসহ ব্যবহার করেছেন ক্যানভাসে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই ইসলামে তার অগাধ শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস। ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মে তিনি বিশ্বাস করেন না। হিন্দুত্বের প্রতি অবিশ্বাস থেকেই লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে উলঙ্গ এঁকেছেন। তিনি কি মুহম্মদ কে উলঙ্গ আঁকবেন? আমি নিশ্চিত, তিনি আঁকবেন না। আমার কোনও অসুবিধে নেই সব ধর্মের দেবদেবী বা পয়গম্বরদের উলঙ্গ আঁকতে। পৃথিবীর সব ধর্মের প্রতি আমার সমান অবিশ্বাস। কোনও ধর্মকে একটির ওপরে স্থান দেবো, একটিকে ঘৃণা করবো, আরেকটিকে ভালোবাসবো, বা বিশ্বাস করবো, এই সমস্যা আমার নেই। সব ধর্মই বলে তোমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ এবং সত্য এবং নির্ভুল, তোমার ঈশ্বরই সত্যিকার ঈশ্বর, বাকি ধর্ম ভুল, বাকি ঈশ্বর মিথ্যে! এই শিক্ষা নিয়ে গড়ে ওঠা ধর্মান্ধ সন্ত্রা সীরা খুব সহজেই বিধর্মীদের আক্রমণ করে। ক্রিশ্চান সন্ত্রাসীরা একসময় ভীষণ সন্ত্রাস চালিয়েছে, ইওরোপে। এখনও গর্ভপাতের বিরুদ্ধে থেকে থেকে তারা হিংস্রতা দেখাচ্ছে। হিন্দু সন্ত্রাসী সম্প্রতি আক্রমণ করেছে ভারতের অযোধ্যায়, গুজরাতে মুসলমান সন্ত্রাসীদের আক্রমণে ভারতবর্ষ কেন, সারা বিশ্বই কেঁপে উঠছে বারবার।