তারপর আবার কমপিউটারে লিখলো, স্টাডির বেডে ঘুমিয়ে পড়লো।
কটায় ঘুমিয়েছিল?
এগারোটা সাড়ে এগারোটায়।
এদিকে বেডরুমে তো আমরা আড্ডা দিয়ে অনেক রাতে ঘুমিয়েছি।
ওই সময় কোথাও গেল?
না, ওই সময় ন স্টাড়িতে বসে ওর একটা বই পড়ছিল।
যখন ও ঘুমোচ্ছিল?
হ্যাঁ যখন ঘুমোচ্ছিল।
আর আজ সকালে তো সাতটায় উঠলো। নিজেই চা করে খেলো।
তাহলে গেল কখন?
সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু গেছে তো নিশ্চয়ই।
আলমারির ভেতরে গেটের চাবি। আলমারির চাবি তো তোর কাছে।
হ্যাঁ আমার পকেটে।
কীরকম মিসটেরিয়াস লাগছে সবকিছু।
বড় ভুতুড়ে ব্যাপার।
শাড়িটা কোন ঘরে পরেছে। টেরই পেলাম না।
লাল শাড়ি আবার কবে কিনলো, ওর কোনও লাল শাড়ি নেই তো। কোনওদিন দেখিনি।
হয়তো কিনেছে এর মধ্যে।
কালই তো আলমারি খুলেছিল। শাড়িগুলো দেখলাম সব।
হয়তো আমরা জানি না লাল শাড়ির খবর। অন্য কোথাও ছিল হয়তো।
কোথায় থাকবে শাড়ি।
আজকাল তো শাড়ি টাড়ি পরে না।
অথচ দেখ, কাল শাড়ি পরে বেরোলো। কে বললো পরে না। ঠিকই পরে।
কোথায় শাড়িটা পরলো ভাবছি।
কোনও ঘরে নিশ্চয়ই পরেছে।
হয়তো বাথরুমে।
কিন্তু বাথরুমে তো একবারই গিয়েছিল। বেরোলো যখন, তখন তো শর্টসই ছিল পরনে।
এর মধ্যেই বেরিয়ে গেছে আমরা কেউ বুঝতেই পারিনি।
কাউকে বললো না? কী আশ্চর্য!
আলমারির চাবিটা যে কী করে নিল। দেখ, কাউকে কিছু বললো না। বললে কী হতো?
লুকিয়ে যাওয়ার কী ছিল, আমাদের কেউ তো সঙ্গে যেতে পারতাম।
.
সবাই যখন আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, বিশ্বাস করছে, কোনও প্রমাণ নেই বাইরে বেরোবার, তারপরও বিশ্বাস করছে, বাড়িতে ছিলাম তার সমস্ত প্রমাণ থাকার পরও করছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম,– তোমাদের কারো কি একবারও মনে হচ্ছে না কাগজ ভুল লিখেছে? তোমরা সবাই জানো, কাল সারাদিন আমি তোমাদের সঙ্গেই এখানে ছিলাম, রাতে তোমাদের সামনেই ঘুমিয়েছি। তোমাদের কেউ দেখনি আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখনি, কারণ আমি বেরোইনি। তাহলে কেন মনে হচ্ছে না কাগজের লোকেরা কিছু ভুল করেছে?
না কারও এরকম মনে হচ্ছে না যে কাগজে ভুল লিখেছে। কারণ কাগজে ছাপার অক্ষরে লেখা আছে যে আমি কাল নদীর ধারে আনমনে হেঁটেছি, সুতরাং এ মিথ্যে হতে পারে না। বাড়িতে এতগুলো মানুষ থাকা সত্ত্বেও, সবার চোখের সামনে রক্ত মাংসের আমি ছোট একটা তিনরুমের ফ্ল্যাটে সারাদিন কাটালেও, আমার বাইরে যাওয়ার কোনও প্রমাণ না থাকলেও ওদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমি বাইরে গিয়েছি, নদীর ধারে হেঁটেছি।
কেউ বিশ্বাস করে না কোনও বড় পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে কিছু লেখা ছাপা হলে সেই লেখা কখনও ভুল হতে পারে। ওরা জ্বলজ্যান্ত আমাকে অস্বীকার করে, ওরা। ওদের চোখকে অস্বীকার করে, কিন্তু কাগজের মিথ্যেকে সত্য বলে মানে। আমি যাদের কথা বলছি, তারা সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ। তারা আছে বলেই সম্ভবত মিডিয়া আছে।
যার কেউ নেই তার নাকি ভগবান আছে। এই মিডলক্লাস মিডিওকারদের জন্য মিডিয়াই ভগবান। ভগবান কি কখনও ভুল করতে পারে! ভুল মানুষ করে।
মিল এবং অমিল
অনেকে সালমান রুশদির সঙ্গে আমার নামটা প্রায়ই উচ্চারণ করে, দেশে বিদেশে সবখানে। কিন্তু একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজনের যদি বিরাট পার্থক্য থাকে, তবে এই উচ্চারণ খুব স্বাভাবিক, যে, অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাকে যখন সরাস রিই বলা হয় আমি মহিলা রুশদি, আজকাল প্রশ্ন করি, সালমান রুশদিকে বরং পুরুষ নাসরিন বলছো না কেন শুনি? এক ফতোয়া ছাড়া, আমি বেশ ভালো জানি, যে, আমাদের মধ্যে যা আছে, সব অমিল। রুশদি পুরুষ। আমি মেয়ে। এটা অনেক বড় অমিল। পুরুষ হওয়ার কারণে তিনি সুবিধে ভোগ করেন আর মেয়ে হওয়ার কারণে আমি অসুবিধে ভোগ করি। অমিলগুলো এক এক করে বলছি– ফতোয়া জারি হওয়ার পর রুশদি মৌলবাদীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, তওবা করে খাঁটি মুসলমান। হওয়ার পণ করেছিলেন। আমি ক্ষমা চাইনি। আমি মুসলমান হতেও চাইনি। শৈশব থেকেই আমি নাস্তিক, মাথা উঁচু করে সেই নাস্তিকই রয়ে গেছি, যত ঝড়ঝাঁপটাই আসুক না কেন। যে দেশ থেকে রুশদির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছিলো, সেই ইরান। নামের দেশে রুশদি কোনওদিন বাস করেননি। যে দেশে আমার ফাঁসি চেয়ে জঙ্গিদের মিছিল হয়েছে বছরের পর বছর, যে দেশে আমাকে হত্যা করার জন্য অসহিষ্ণু মুসল মানরা উন্মাদ হয়ে উঠেছিলো, যে দেশে সরকারের রুজু করা মামলার কারণে আমার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছিলো, আর তার ফলে আমাকে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে মাসের পর মাস, যে দেশে আমাকে হাতের কাছে পেলে মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা ছিঁড়ে ফেলতো, সেই দেশেই আমি যাবতীয় তাণ্ডবের সময় সশরীরে উপ স্থিত ছিলাম। মৌলবাদী এবং সরকারের সকল অত্যাচার আমাকে সইতে হয়েছে একা। ফতোয়ার কারণে রুশদিকে কেউ তাঁর দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়নি। তাঁর নির্বা সনদণ্ড হয়নি। ইংলেণ্ড রুশদির দেশ, ওখানে তিনি ছিলেন, ওখানেই তিনি থাকছেন। রুশদির ওপর জারি হয়েছে সাকুল্যে একটি ফতোয়া, আমার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে তিনটে ফতোয়া, ভারত থেকে পাঁচটা। সবগুলোতেই মাথার দাম ধার্য করা হয়েছে। রুশদিকে কোনও দেশ থেকে নয়, আমাকে দু দুটো দেশ থেকে আমার লেখার কারণে তাড়ানো হয়েছে। রুশদির একটা বই নিষিদ্ধ হয়েছে, আমার পাঁচটা বই নিষিদ্ধ। লজ্জা, আমার মেয়েবেলা, উতল হাওয়া, দ্বিখণ্ডিত, সেই সব অন্ধকার। রুশদি ধর্মের নিন্দা করলেও ধর্মমুক্ত মানববাদী কোনও দলের সঙ্গে বা মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে জড়িত নন, আমি সক্রিয়ভাবে জড়িত। ব্যক্তিজীবনে রুশদি অত্যন্ত উন্নাসিক লোক, আমি সম্পূর্ণ তার বিপরীত। রুশদি একটার পর একটা নিজের হাঁটুর বয়সী মেয়েদের ধরছে, ভোগ করছে আর ছাড়ছে। তাঁর বুড়ো বয়সের ভীমরতিকে ভীমরতি হিসেবে দেখা হয়না বরং তাঁকে বেশ শক্ত সমর্থ সুঠাম সুন্দর প্রেমিক হিসেবেই সম্মান করা হয় এবং বেশির ভাগ পুরুষের কাছে তিনি ঈর্ষার পাত্র হয়ে ওঠেন। আর, এদিকে পু রুষসঙ্গীহীন জীবন কাটালেও আমাকে নিয়ে নানারকম যৌনতার কেচ্ছাকাহিনী লিখে বেড়ানো এবং আমাকে বেশ্যা বা বিকৃত মেয়েমানুষ বলার লোকের অভাব নেই। যৌন জীবন উপভোগ করবে পুরুষ। মেয়েরা তা উপভোগ করলে বাউপভোগ করার অধিকারের কথা বললে বা লিখলে সে বেশ্যা। লেখালেখি শুরু করার শুরু থেকে লোকের নিন্দা আর ছিছি শুনে আসছি। মেয়েদের যৌন স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করে আমি নাকি সমাজের বারোটা বাজাচ্ছি। রুশদির সঙ্গে আর একটা চমৎকার মিল বা অমিল আমার আছে। রুশদিকে যারা ভালো লেখক বলে, তাদের বেশির ভাগ লোকই রুশদির লেখা পড়েনি। আমাকে যারা খারাপ লেখক বলে, তাদের বেশির ভাগ লোকই আমার লেখা পড়েনি।