ফোন রেখে দিয়ে অন্য এক বন্ধুকে ফোন করলাম।
ফোন করতেই ও বললো, সূর্য কি পশ্চিমদিকে উঠলো?
ত– কেন?
প– আমাকে ফোন করলে! তুমি তো ফোন করো না তাই বললাম।
ত– আজকের আনন্দবাজার পড়েছো?
প– হ্যাঁ পড়েছি। তোমার অংশটুকু বেশ লাগলো কিন্তু।
ত– কেন বেশ লাগলো? কী লিখেছে?
প– লিখেছে বেশ আছো।
ত– বয়সের কথা কী লিখেছে?
প– বয়স বাহান্ন।
ত– কী করে? তুমি তো জানতে আমি পঞ্চাশ। তাই না?
প– পঞ্চাশ নয়। বাহান্ন।
ত– কেন? বাহান্ন কেন?
প– আনন্দবাজার তো বাহান্নই লিখেছে।
ত– তুমি তো আমার পঞ্চাশ পালন করতে এসেছিলে, তাই না? আবার একান্ন পালন করতেও আসবে বলেছো, তাহলে বয়স আমার কী করে বাহান্ন হলো?
প– ছাড়ো তো, পঞ্চাশ আর বাহান্ন, একই জিনিস।
ত– কিন্তু একই জিনিস তো নয়! তোমার কি বাহান্ন শব্দটা পড়ে একটুও অবাক লাগেনি?
প– কই না তো?
ত– কেন?
প– কেন অবাক লাগবে। অবাকের কী আছে?
ত– কাগজে ভুল লিখেছে বলে মনে হয়নি?
প– কাগজে কেন ভুল লিখবে? আমি তো কোনও কারণ দেখছি না। তোমার বয়স ভুল লেখার পেছনে কাগজের কী স্বার্থ?
ত– তুমি তাহলে মনে করছো, যেহেতু আমার বয়স ভুল লেখার পেছনে ওদের কোনও স্বার্থ নেই, তাহলে যে বয়সটাই লিখেছে, সেটাই ঠিক বয়স?
প– হ্যাঁ। কেন? ঠিক নেই?
.
এর মধ্যে অন্য এক বন্ধু ফোন করলো। কলকাতা থেকেই।
ত– এই, আমার বয়স নাকি আজ আনন্দবাজারে বাহান্ন লিখেছে?
স– হ্যাঁ তাই তো পড়লাম। আমি তো জানতাম পঞ্চাশ।
ত– তারপর?
স– কবে এদিকে বাহান্ন হয়ে বসে আছো, সে খবর তো জানি না।
ত– তোমার হাতের কাছে আমার কোনও বই আছে?
স– ঠিক হাতের কাছে নেই। পাশের ঘরে যেতে হবে। ওখানে আছে।
ত– যাও ওখানে। একটা বই নিয়ে খোলো তো।
স– যাচ্ছি।
ত– বই খোলো। কী লেখা আছে?
স– লেখা তো জন্মসাল ২৫ আগস্ট, ১৯৬২.
ত– গোনো এখন। কত দাঁড়ায় বয়স?
স–(গোনার পর) দাঁড়ায় তো পঞ্চাশ।
ত– তাহলে কেন বলছো, বাহান্ন হয়ে গেছি।
স– কারণ কাগজ তো ভুল করে না।
ত– কাগজে কখনো কোনও মিসইনফরমেশন পাওনি? ভুল সংবাদ পড়োনি?
স– আমি তো বুঝতে পারছি না ভুল টা কেন করবে ওরা। ইনটেনশ্যানালি করেছে বলতে চাও?
ত–ইচ্ছে করে করেনি। ধরো, ভুল করেছে। হতে পারে না? ভেবেছে আমার বাহান্ন। কোথাও চেক করে দেখেনি ঠিক আছে কি না। হতে পারে না?
স– ওরা ভুল করেছে? কেন করবে?
ত– যেহেতু তুমি বুঝতে পারছে না ভুল টা কেন করবে ওরা, তাই ওরা কোনও ভুল করেনি!
স– সম্ভবত কাগজের অন্য কোনও হিসেব আছে।
ত– হিসেব? যেমন?
স– যে বয়সে পা দিলে তুমি, সেটা হয়তো কাউন্ট করে না, যে বয়সে পা দেবে সেটা কাউন্ট করে।
ত–মানে ভবিষ্যতের বয়সটা?
স– ধরো তাই।
ত–মানে আমি একান্ন হবো, সেই ভবিষ্যতের বয়সটাই আমার বয়স?
স– হ্যাঁ।
ত–ঠিক আছে, তাহলে তো আমি একান্ন হবো, বাহান্ন আসে কোত্থেকে।
স– একান্নয় আর বাহান্নয় খুব কি আর পার্থক্য আছে?
ত– তাহলে তুমি মনে করছো, ভবিষ্যতের যে বয়সটা আমার হতে যাচ্ছে, সেটা এখনই দিয়ে রাখলে কোনও অসুবিধে নেই।
স– অসুবিধে কেন?
এরপর আমি আর তর্কে যাইনি।
এ কিছুই নয়। মানুষ ছাপার অক্ষরকে কী রকম বিশ্বাস করে তার একটা বড় অস্বস্তিকর ঘটনার সাক্ষী আমি। আমি তখন গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। সেসময় বেশ কয়েকজন বন্ধু আর আত্মীয় আমার বাড়িতে এসেছিল। কেউ কোথাও যাইনি সারাদিন। সবাই সারাদিন বাড়িতে। খাওয়া দাওয়া, চা, আড্ডা, ছবি এসবই হয়েছে দিনভর, রাতভর। পরদিন সকালে পত্রিকা এলো, ওতে লেখা, কাল আমাকে নদীর ধারে লাল শাড়ি পরে আনমনে হাঁটতে দেখা গেছে একা একা। আমি দুদিন যাবৎ ঘরে একটা নীল টী সার্ট আর সাদা একটা শর্টস পরে ছিলাম। সবার চোখের সামনেই। সবাই জানে কাল আমি কোথাও বেরোইনি। শুধু কাল কেন, গত দুমাস আমাকে ঘর থেকে বেরোতে দিচ্ছে। না সরকার। দিচ্ছে না বলেই, আমার বেরোনোর অনুমতি নেই বলেই বন্ধুরা আমাকে সঙ্গ দিতে এসেছে। কিন্তু খবরের কাগজের ওই লেখাটা পরে সবাই এর ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। ফিসফিস করে বলতে শুরু করলো–
বাইরে কখন গেছে, জানতেই পারলাম না আমি। এই তুই দেখেছিস?
আমি দেখিনি।
তাহলে দেখেছে কে?
তুমি জানো?
আমি তো দেখিনি।
ব কে জিজ্ঞেস করো তো, ব দেখেছে?
না, আমি তো দেখিনি। দরজা তো আমিই ভেতর থেকে তালা দিয়ে রেখেছি। চাবি আমার ব্যাগে, আলমারিতে।
আলমারির চাবি কার কাছে?
ওটিও আমার কাছে।
ব কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
আমি তো রাত দুটোয় শুতে গেলাম।
না না তাহলে নয়। কাগজে লিখেছে বিকেলে।
ট বিকেলে কী করছিলে?
বিকেলে তো সবাই ছবি দেখছিলাম।
ওই সময় কী করে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে গেল, টেরও পাইনি।
ছবিটা যখন চলছিল। একবার দেখেছিলাম বারান্দায় গেল।
বারান্দায় নয়, বাথরুমে গিয়েছিল। ও বেরোলে আমি গেলাম।
বাথরুম থেকেই কি চলে গিয়েছিল?
বাথরুম থেকে তো ঘরে এসেছিল ছবি দেখতে।
সকাল আটটায় উঠেছে, নটায় ব্রেকফাস্ট করেছে। দশটার দিকে কী করলো?
দশটায় চা খেতে খেতে পেপার পড়লো আর পুরোনো দিনের গল্প করলো। ট আর ন গান গাইলো, শুনলো।
বারোটা পর্যন্ত তো তাই হলো। তারপর রান্না করলো। দুপুরে সবাই মিলে খেলাম। খাওয়ার পর তো অপর্ণা আর ঋতুপর্ণের ছবি, পর পর দেখা হল। ছবি দেখা শেষ হল সন্ধেয়, সাড়ে ছটার দিকে। তারপর আবার চা খেলো, তাস খেললো, কমপিউটারে কী কাজ করলো, নটা পর্যন্ত। নটায় ডিনার করলো। তারপর?