ষাট দশকের শেষ দিকে সমাজের বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ। বেরিয়ে এসেছিল পুরোনো রাজনীতি আর পুরোনো সমাজব্যবস্থা আমূল পাল্টে ফেলতে। ভালো মেয়ে হতে হলে কৌমার্য, সতীত্ব, মাতৃত্ব ইত্যাদি রক্ষা করতে হয় — পুরোনো এই ধারণাটির গায়েও কুড়োল বসিয়েছিল। রীতিমত বিয়ে করাই বন্ধ করে দিয়েছিল সেদিনকার হিপিরা। অনেকে একবাড়িতে বাস করতো, কেউ কারও সম্পত্তি ছিল না, সবার সঙ্গে সবারই সেক্স হত, বাচ্চাকাচ্চা হলে সবাই মিলে লালনপালন করতো। সেই কমিউন জীবন বেশি বছর টেকেনি। হিপিরা জয়ী হলে আজ বিয়েটা ইতিহাসের পাতায় স্থান পেতো, সমাজে নয়।
অনেক কবি সাহিত্যিক দার্শনিক বিয়ে সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, বিয়েটা যে অন থক একটা জিনিস, তা বেশ কায়দা করে বুঝিয়েও দিয়েছেন। নিজের বিয়ের আর। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পার্থক্য একটাই, বিয়ের ফুলগুলোর গন্ধ শুঁকতে পারো, আর অন্ত্যে ষ্টির ফুলগুলোর পারো না। অস্কার ওয়াইল্ড বলতেন, সবসময় প্রেম ভালোবাসায়। ডুবে থাকা উচিত। সে কারণেই কখনও বিয়ে করা উচিত নয়। ক্যাথারিন হেপবার্ন সে আমলেও নারী পুরুষের এক বাড়িতে বাস করার পক্ষে ছিলেন না। বলেছিলেন, একটা নারী আর একটা পুরুষ পরস্পরের সব কিছু পছন্দ করছে? যদি এরকম ঘটনা ঘটেই থাকে, তবে সবচেয়ে ভালো হয় তারা যদি একই পাড়ায় থাকে, মাঝে মাঝেই দেখা হবে! এও বলেছিলেন, একটা লোক অপছন্দ করবে বলে যদি অনেক পুরুষের প্রেমকে তুচ্ছ করতে চাও,তা হলে যাও, গিয়ে বিয়ে করো। অসাধারণ কিছু মন্তব্য করেছেন কজন ব্যক্তিত্ব। বিয়েটা চমৎকার আবিষ্কার, ঠিক যেমন সাইকেল মেরামত করার যন্ত্রটাও চমৎকার আবিষ্কার। বিয়েটা একটা খাঁচা, খাঁচার বাইরের লোকেরা খাঁচায় ঢোকার জন্য ব্যাকুল, আর খাঁচার ভেতরের লোকেরা খাঁচা থেকে বেরোবার জন্য ব্যাকুল। বিয়েটা শুধু তাদের জন্য ভালো, যারা একা ঘুমোতে ভয় পায়। অন্য আরও কজন বলেছেন, বিয়েটা চমৎকার ইনস্টিটিউশন। কিন্তু কে চায় ইনস্টিটিউ শনে বাস করতে? প্রেমিকের স্নায়ুতন্ত্র পুরোটা উপড়ে তুলে নিলে যেটা পড়ে থাকে, সেটা স্বামী। বিয়েটা ঘুষ, যেন বাড়ির চাকরানী নিজেকে বাড়ির মালিক বলে মনে করতে পারে। ফরাসি লেখক বালজাক বলেছিলেন, বেশির ভাগ স্বামীকে দেখলেই আমার সেই ওরাংওটাংটির কথা মনে পড়ে, যে খুব বেহালা বাজানোর চেষ্টা করছিল। সব মন্তব্যই বিয়ের বিপক্ষে নয়। পক্ষেও কিছু মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। যেমন, যদি এমন কোনও ধনকুবের পুরুষের দেখা পাই, যে প্রতিজ্ঞা করবে তার সহায় সম্পত্তির অর্ধেকটা আমায় লিখে দেবে, লিখে দিয়ে এক বছরের মধ্যে মরে যাবে, তবে তাকে আমি নিশ্চয়ই বিয়ে করবো।
পাশ্চাত্যে যখন হিপি বিপ্লব, নারী স্বাধীনতার আন্দোলন, প্রাচ্যে তখনও মেয়েদের হাতেপায়ে অদৃশ্য শেকল, যৌনাঙ্গে অদৃশ্য সতীত্ববন্ধনী। বিয়েটা যে কারণে শুরু হয়েছিল, প্রাচ্যের বেশির ভাগ পুরুষ এখনও সেই কারণেই বিয়ে করে। একটা জরায়ু দরকার, যে জরায়ু একটা নির্দিষ্ট পুরুষের ঔরসজাত সন্তান ধারণ করবে। পিতৃত্বের নি শ্চয়তাই বিয়ের মূল উদ্দেশ্য। পুরুষের স্বার্থে পুরুষকে বিয়ে করে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রাখছে মেয়েরা। মেয়েরা বেঁকে বসলে পুরুষতন্ত্রের বিরাট বেলুনটি সশব্দে চুপসে যেত কবেই!
বাঙালি সমাজে দেখেছি, বিয়ের পর মেয়েদের ডানাটা গোড়া থেকে কেটে দেওয়া হয়। নিজের ঘরদোর-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব-পরিবেশপ্রতিবেশ-শহরবন্দর সব ছাড়তে হয় মেয়েদের নিজের নামের শেষে স্বামীর পদবী জুড়তে হয়। শ্বশুর বাড়িতে বাস করতে হয়। মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলেও, শিক্ষিত হলেও, সে চাকরি করবে কি করবে না সেই সিদ্ধান্ত স্বামী এবং স্বামীর আত্মীয় স্বজন নেয়। একসময় তো প্রচলিত ছিলই, এখনও অনেকে বলে, যে, বিয়ের পর চাকরি করা চলবে না। সতী-সাবিত্রীর জীবন চাই, এ কারণে ঘরে থাকাটা ভালো, ঘর পয়পরিষ্কার করবে, রান্না বান্না করবে, পরিবেশন করবে, পরিবারের সবার সেবাযত্ন করবে, সন্তান মানুষ। করবে। গ্লোরিয়া স্টাইনেম একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন, সে-ই স্বাধীন মেয়ে, যে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক করে, আর বিয়ের পরে, চাকরি। আজকাল অবশ্য স্বামী এবং স্বামীর আত্মীয় স্বজন শিক্ষিত বা কর্মক্ষম মেয়েদের শুধু ঘর সংসারের কাজ করিয়েই তুষ্ট নয়, তারা চায় মেয়েরা বাইরেও চাকরি করুক, সংসারে বাড়তি রোজ গারটা হোক। পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের রোজগার বেশি হলেও মেয়েদের রোজগা রকে বাড়তি বলার প্রবণতা বাঙালির ঘরে ঘরে। পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত মেয়েরা নিজের রোজগারের টাকাটা স্বামীর হাতে সমর্পণ করে লক্ষ্মী মেয়ে উপাধি পায়। মেয়েদের রোজগারের টাকা কী খাতে খরচ হবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক মেয়েরা নয়, অধিকাংশ সময়ই পুরুষ, সে যতই গবেট পুরুষই হোক না কেন। টাকাপয়সা ভালো রোজগার করতে পারলেও মেয়েরা ঠিক টাকাপয়সাটা নাকি বোঝে না, সে কারণে টাকা পয়সা জনিত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পুরুষেরাই নিজ দায়িত্বে নিজের ঘাড়ে নিয়ে নেয়। অধিকাংশ বাঙালি মেয়ে স্বাধীনতা কাকে বলে জানে না।