বোরখার বিরুদ্ধে বলেছেন বলে মিতা হককে নাকি লোকেরা খুব গালি গালাজ করছে। যে পুরুষগুলো বলে বোরখা খুব ভালো পোশাক, সুন্দর পোশাক, চমৎকার। পোশাক, ওই পুরুষগুলো কেন বোরখা পরছে না কেউ জিজ্ঞেস করেছে? কেউ কেন ওদের জিজ্ঞেস করছে না, বোরখা যদি অত ভালো পোশাক, তাহলো তোরা বোরখা পরছিস না কেন? দুদিন ভালো পোশাকটা পরে দেখ না কেমন ভালো লাগে!?
ব্যক্তিগত কিছু ঈর্ষা-জনিত কারণে তাঁর স্ত্রীদের জন্য বোরখার প্রচলন শুরু করে ছিলেন পয়গম্বর। বেশ ছিল। হঠাৎ কী মনে হল কে জানে, বলে দিলেন সব মুসলমান মেয়েকেই এখন বোরখা পরতে হবে। চৌদ্দশ বছর আগে যে কারণেই মুসলমানদের মধ্যে বোরখার চল শুরু হোক না কেন, এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে মেয়েদের বোরখা পরার পেছনে কোনও যুক্তি নেই। সত্যি বলতে কী, বোরখা মেয়েদের কাজে লাগে না, লাগে পুরুষের কাজে। বোরখাআসলে পুরুষের পোশাক, চোর ডাকাত খুনী পুরুষের পোশাক। পুরুষেরা যখন চুরি ডাকাতি করে, খুন করে, বোরখা পরে নেয়। এতে ওদের সুবিধে হয় বেশ, কেউ চিনতে পারে না। চোর ডাকাতের পোশাককে ধর্মের নামে মেয়েদের গায়ে চাপানোর কোনও মানে হয়?
বাবা
ছোট ছিমছাম শহর। দুপুরবেলায় রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। কিছু কুকর জিভ বার করে হাঁটে, কিছু গাছের ছায়ায় ঘুমোয়। রাতেও শহরটা নৈশব্দের কুয়োর মধ্যে ডুবে থাকে। এমন এক শহরে হঠাৎ করে নানা রকম লোক আসতে শুরু করেছে, কারণ কল কারখানা গড়ে উঠছে, প্রচুর কাজ জুটছে লোকের। মাটির তলায় প্রাকৃতিক গ্যাস। আবিষ্কার হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে, এরপর শহরের লোকেরা হয়তো ভুলেও গিয়েছিল গ্যাসের কথা, কিন্তু রাজধানীর লোকেরা ভোলেনি। দিব্যি গ্যাস তোলার দিন তারিখ ঠিক করে ফেলেছে। রীতিমত ঘোষণা দিয়ে নেমে পড়া যাকে বলে। পিঁপড়ের মতো মানুষ আসছে আশেপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে। শহরে যেন গ্যাস নয়, গুড় পাওয়া গেছে কোথাও, ফ্রি গুড়।
এসময়, যখন চারদিকে লোকেরা চাকরি পাচ্ছে, বাবার চাকরিটা চলে গেল। বাবা একটা ফার্নিচার কোম্পানীতে ডিজাইনারের কাজ করতো। কোম্পানীটা যে বিল্ডিংএ ছিল, সেটাকে এখন গ্যাসের বিল্ডিং করা হয়েছে। আশেপাশে যে কটা বিল্ডিং ছিল, কিনে নিয়েছে গ্যাসের লোকেরা। কোম্পানীর মালিক বলেছেন সময়মতো বাবাকে জানানো হবে কবে থেকে ফের চাকরিতে যোগ দিতে হবে। বাবা ছমাস বসে কাটালো। সংসার তো এভাবে চলে না। মামারা সাহায্য করছে। ছমাস বাবা নানারকম ব্যবসায় টাকা খাঁটিয়ে টাকার সর্বনাশ করেছে। বাড়িটায় ঝাঁক ঝাঁক হতাশ কুণ্ডুলি পাকিয়ে কুকুরের মতো শুয়ে থাকে দিন রাত। ডানাও নেই যে তাড়ালে কোথাও উড়ে যাবে। চারদিক থেকে প্রচুর পরামর্শ আসছে, রামেন্দু-বাবার সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ। রামেন্দু-বাবার নাম বছর দুই হলো সবার মুখে মুখে। তার আশীর্বাদের ফলে নাকি লোকের চাকরি জুটছে, ব্যবসাপাতি ভালো হচ্ছে। বাবা শুনে উড়িয়ে দিয়েছিল। বাবা কোনও বাবায় বিশ্বাস করে না, সাফ সাফ বলে দিয়েছিল। চেঁচিয়ে বলেছিল, আমি যাবো লোক ঠকানো ভণ্ড লোকের কাছে আশীর্বাদ চাইতে? আমি নয়, আমার লাশ যাবে।
সপ্তাহ চার পরে বাবার লাশ নয়, বাবা নিজেই গিয়েছে রামেন্দু-বাবার বাড়িতে। ফিরেছে হাসিখুশি মুখে। এরপর প্রতিদিনই গেছে। আপাদমস্তক বিজ্ঞান-বিশ্বাসী মানুষ চোখের সামনে রামেন্দু-বাবার ভক্ত বনে গেল। রামেন্দু-বাবা আশা দিয়েছে, ভালো চাকরি বা ভালো ব্যবসা বাবার শীঘ্র হবে। কিছুদিন পর বাবা বললো, রামেন্দু-বাবা বাড়ির সবাইকে নিয়ে তার কাছে যেতে বলেছে সামনের সপ্তাহে। আমি বলে দিয়েছি, যাবো না। মুহূর্তে বাবার ওই হাসিখুশি মুখখানা মলিন হয়ে গেল। তারপর অবশ্য বাবার মুখে হাসি ফেরাতে আমাকে বলতেই হয়েছে, যাবো। বাড়ির সবাই বলতে বাবা, মা, আমি আর আমার ছোটভাই সন্তু। আমরা গেলাম একদিন ঠিক ঠিক। আমাদের ভালো ভালো জামাকাপড় পরে গেলাম। রামেন্দু-বাবা গেরুয়া রংএর কাপড় গায়ে। পেঁচিয়ে রেখেছে। আশেপাশে লোক প্রচুর। উঠোনে মখমলের চাদর বিছানো। সারা বাড়িতে রামেন্দু-বাবার বড় বড় মূর্তি। যেন ভগবান তিনিই। বাবা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো, মাও করলো, আমাকে আর সন্তুকে বলা হলে সন্তু করলো, আমি করিনি। লোকটা শুরু থেকেই আমার দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছিল আমার ভালো লাগছিল না। রামেন্দু-বাবার চোখের চেয়ে অগ্নির চোখের চাহনি ভালো লাগে আমার। অগ্নি আমার বন্ধু। ভালো লাগা পর্যায়ে অগ্নির সঙ্গে সম্পর্কটা আটকে আছে। বাবা পছন্দ করলেও, অগ্নিকে পছন্দ নয় মার। মা বলে, অগ্নি ছোট জাত। জাতপাত আমি মানি না। আমি অনেকটা বাবার মতো। বাবাও জাতপাত মানে না। কিন্তু বাবাও রাগ করেছিল অগ্নির সঙ্গে যখন আমি জয়দেবের মেলায় গিয়েছিলাম। ফিরেছিলাম তিনদিন পর। মা বলেছিল, বিয়ের আগে মেয়েরা কারও সঙ্গে সম্পর্ক করলে পরে বর পেতে অসুবিধে হয়। এসব খবর চাপা থাকে না। জয়দেবের মেলায় তিনদিন হারিয়ে যাওয়ার খবর পাত্রপক্ষ ঠিকই নেবে। মা তারপরও অগ্নিকে পাত্র বলে ভাবতে পারেনি। মাথায় হাত ছুঁইয়ে চুঁইয়ে সবাইকে আশীর্বাদ করলো রামেন্দু-বাবা। শুধু আমাকেই হেঁচকা একটা টান দিয়ে নিজের কোলের কাছে নিয়ে পিঠে আর মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বললো, এ খুব দুষ্ট, তাই না, এ তো আমাকে প্রণাম পর্যন্ত করলো না, কী, এই মেয়ে কি ভগবানে বিশ্বাস করে না? মা তাড়াতাড়ি বললো, হ্যাঁ তা নিশ্চয়ই করে, আসলে ওর অনেকদিন মনটা ভালো নেই,শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলো। এন্ট্রান্স পরীক্ষা নিয়ে টেনশনে থাকে খুব। অনেক জায়গায় অ্যাপ্লাই করেছে। রামে দু-বাবা হেসে বললো, তাই নাকি? তাহলে ওকে শনিবারে আর মঙ্গলবারে পাঠিয়ে দিও আমার কাছে, বিকেল পাঁচটায় চলে এসো মা, বুঝলে? দুচারদিন আশীর্বাদ নাও, আমার কথা মেনে কাজ করো, শরীর মন সব ঠিক হয়ে যাবে। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ হবে। চিন্তামুক্ত থাকো।